শহরের এক প্রান্তে সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো বাতিঘরটা নিয়ে বহু গল্প প্রচলিত। জীর্ণ বাতিঘরটা আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, তবে বহু বছর ধরে সেটি পরিত্যক্ত। লোকে বলে, বাতিঘরটা অভিশপ্ত। সেখানে একসময় কেউ এক রাতের মধ্যে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল, আর সেই রাতের পর থেকেই বাতিঘরটি পরিত্যক্ত করে দেয় সবাই। স্থানীয় লোকেরা দাবি করে, সেখানে গেলে নাকি অদ্ভুত ছায়া, ফিসফিস আওয়াজ আর কাঁচ ভাঙার শব্দ শোনা যায়।
এইসব গল্প শুনে পাঁচজন বন্ধুর মধ্যে কৌতূহল জন্মালো। তারা ঠিক করল একদিন রাতের বেলা সাহস করে বাতিঘরটায় যাবে। বন্ধুরা হলো আরাফ, রিয়া, সামির, নিলয় আর মুনা। রিয়া প্রথমে একটু দ্বিধায় ছিল, কিন্তু বাকিরা তার সাহস বাড়াতে থাকলো। অবশেষে এক রাতে, ঠিক করেই ফেললো, আজই তারা বাতিঘরে যাবে এবং সত্যিই সেখানে কিছু আছে কি না, তা নিজের চোখে দেখে আসবে।
সন্ধ্যার পরেই সবাই সমুদ্রের দিকে রওনা দিল। বাতিঘরের চারপাশে একধরনের ভৌতিক নীরবতা, আর ঢেউয়ের গর্জন বাতাসে মিশে একটা ভয়ঙ্কর পরিবেশ তৈরি করছিল। বাতিঘরের কাছে পৌঁছে, সবাই একটু থেমে গেল। বাতাসের শীতলতা তাদের শিরদাঁড়ায় ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে দিল।
"চলো, ভয় পেলে চলবে না। আমরা সবাই একসঙ্গে আছি," সামির সাহস দিল বাকিদের।
একটা পুরোনো দরজা ঠেলে তারা ভেতরে ঢুকলো। বাতিঘরের ভেতর অন্ধকার, ধুলায় ঢেকে থাকা মেঝে, আর দেয়ালে শ্যাওলা জমে আছে। একটু ভেতরে যাওয়ার পরই মুনা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, "দেখো, ওখানে কিছু আছে!"
সবাই দৌড়ে গেল, এবং দেখে এক কোণে একটা পুরোনো ডায়েরি পড়ে আছে। ধুলোমাখা সেই ডায়েরিটা খুলতেই ভেতরে কিছু লেখার চিহ্ন দেখা গেল। প্রায় বিবর্ণ হয়ে যাওয়া সেই লেখা, কিন্তু কিছুটা পড়া যায়। ডায়েরিতে এক অজানা ব্যক্তির হাতের লেখা:
**"আজ রাতেই আমি আমার শেষ সত্যি বলে যাবো। কেউ যদি এই ডায়েরি পায়, জেনে রেখো, আমি মরে গেছি। আমাকে কেউ হত্যা করেছে। আমার নাম — সায়ন্তনী।"**
এই কয়েকটা লাইন পড়েই বন্ধুরা একে অপরের দিকে তাকালো। এত বছর ধরে এখানে কেউ আসে না, তাহলে এই ডায়েরি কি সত্যিই সেই সায়ন্তনীর? তার মানে তার মৃত্যুটা আসলে ছিল না প্রাকৃতিক?
রিয়া বলে উঠল, "বুঝলে তো! এটাই সেই বাতিঘরের রহস্য, সায়ন্তনী এখানেই মারা গিয়েছিল।"
আরাফ বলে উঠল, "কিন্তু ডায়েরি বলছে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তাহলে খুনি কে?"
তারা আরও ভেতরে ঢুকতে শুরু করলো। বাতিঘরের ভেতরকার সরু সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে মুনা বলে উঠল, "আমরা কি সত্যিই ঠিক করছি?"
কেউ উত্তর দিল না। তারা উঠে গেল উপরের ফ্লোরে। সেখানে ঢুকতেই এক কোণায় পুরোনো একটা আলমারি দেখা গেল। আলমারির দরজা একটু খোলা, ভেতরে একটা ছবি রাখা আছে। ছবি হাতে তুলে নিতেই দেখা গেল, একজন তরুণী হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার পাশে একজন মধ্যবয়সী পুরুষ। ছবির পেছনে লেখা সায়ন্তনী এবং অমিত।
নিলয় বলল, "হয়তো এই অমিত-ই সায়ন্তনীর সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু সে কোথায়?" তারা খুঁজতে লাগলো আরও কিছু সূত্র, কিন্তু কিছুই পেল না।
ঠিক তখনই একটা ধাতব শব্দে চমকে উঠল সবাই। আলমারির পাশে ছোট্ট একটা বাক্সে কিছু নড়াচড়ার শব্দ পাওয়া গেল। তারা বাক্সটা খুলতেই ভেতরে কিছু পুরোনো কাগজ আর চাবির একটা রিং পেল। কাগজগুলো পড়তেই বোঝা গেল, এসব সরকারি নথিপত্র। তাতে লেখা ছিল, "সায়ন্তনী দেবী, বাতিঘরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী। প্রায়শই সমুদ্রের গভীর থেকে বিভিন্ন সংকেত পাঠাতেন। কিন্তু হঠাৎই তার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।"
রিয়া ফিসফিস করে বলল, "তাহলে সায়ন্তনী হয়তো কোনও গভীর সিক্রেট জেনে ফেলেছিল, তাই তাকে হত্যা করা হয়েছিল।"
এরপর সবাই চাবির রিং নিয়ে আরও ওপরে উঠতে লাগল। তাদের সন্দেহ হলো, হয়তো সর্বোচ্চ ফ্লোরে কিছু আছে। উঠতে উঠতে চারদিকে একটা গা ছমছমে অনুভূতি হচ্ছিল। বাতিঘরের উপরের অংশে পৌঁছে একটা বন্ধ দরজা দেখতে পেল। চাবির রিং থেকে একটা চাবি নিয়ে দরজা খুলল আরাফ। দরজার ওপাশে ঢুকতেই সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল।
ভেতরে একটা মেঝেতে একটা মানুষের কঙ্কাল পড়ে আছে, এবং চারদিকে রক্তের দাগ। দেয়ালে লেখা ছিল:
আমি সায়ন্তনী। আমাকে অমিত মেরে ফেলেছে, কারণ আমি জানতে পেরেছিলাম তার অবৈধ কর্মকাণ্ডের কথা।
সবাই চুপ হয়ে গেল। তারা বুঝতে পারল, অমিত ছিল সায়ন্তনীর সহকর্মী, আর হয়তো কোন অবৈধ কাজের জড়িত ছিল। সায়ন্তনী তা জানতে পারলে, তাকে হত্যা করে এখানে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।
বন্ধুরা একে অপরের দিকে তাকাল। বাতিঘরের রহস্য তো উদঘাটন হল, কিন্তু তাদের চোখে অশ্রু জমে উঠল। সেই বাতিঘরের দেয়ালের মধ্যে আজও সায়ন্তনীর আত্মা বন্দী হয়ে আছে। তারা প্রতিজ্ঞা করল, এই ঘটনার কথা সবাইকে জানাবে, যাতে সায়ন্তনীর আত্মা এই প্রহেলিকা থেকে মুক্তি পায়।
বাতিঘর থেকে বেরিয়ে এসে তারা পেছনে তাকায়। বাতিঘরের ম্লান আলো যেন সায়ন্তনীর সেই বেদনাময় হাসি। তারা বুঝল, আজকের রাতটা তাদের জীবনের এক অদ্ভুত রহস্যের সন্ধান এনে দিল, যা কখনও ভুলতে পারবে না।
0 মন্তব্যসমূহ