নির্জন স্টেশন

 

নির্জন স্টেশন - nirjon station - horror story - bhoutic - bangla story -storybanglaa - স্টোরি বাংলা - বাংলা স্টোরি
নির্জন স্টেশন

রাত তখন প্রায় এগারোটা। শহরের শেষ প্রান্তে, নির্জনতার এক অতল অন্ধকারে ডুবে থাকা সেই ছোট্ট ট্রেন স্টেশনে এসে দাঁড়ালো সৌরভ। ছোটখাটো একটা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে সে অপেক্ষা করছে ট্রেনের জন্য। জায়গাটা যেন আরও বেশি নির্জন লাগছে, কারণ স্টেশনে আর একটিও লোক নেই। আশেপাশের কোন বাড়িঘর থেকেও কোনো আলো দেখা যায় না। শহরের প্রান্তে এমন একটা স্টেশন ছিল যা শহরের মানুষ প্রায় ভুলেই গেছে। কেউ এখানে ট্রেনে ওঠে না, কেউ নামে না।


একটা দমকা বাতাস সৌরভের মুখে এসে লাগল, আর সঙ্গে সঙ্গেই তার সারা শরীর কাঁপতে লাগল। সে ভেবেছিল ট্রেন এখান থেকে ধরলে ভিড় কম হবে, কিন্তু এই ধরনের নির্জনতা সে আশা করেনি। স্টেশনের ঘড়িতে সময় দেখে, রাতের বারোটার একটু আগে। ট্রেনের সময় ছিল রাত বারোটায়। তবে আশ্চর্যজনকভাবে স্টেশনের ইলেকট্রনিক সিডিউলে এই ট্রেনের কোনো অস্তিত্ব নেই।


সৌরভ একটু অস্বস্তিতে পড়ল। সে দেখল স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে কিছুটা দূরে, একটা পুরনো বোর্ডে লেখা, “স্টেশন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে”। কিন্তু বন্ধ স্টেশনেও ট্রেন আসবে কেন? সবকিছু ভেবেই তার মাথা ঘুরে যাচ্ছে। স্টেশনের চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, আর কুয়াশার চাদরে মোড়ানো। হঠাৎই মৃদু কানে ভেসে আসলো একটা ট্রেনের শব্দ, যেন ট্রেন আসছে।


সে চমকে উঠল। সত্যিই কি ট্রেন আসছে? এমন একটা নির্জন স্টেশনে ট্রেন? বিশ্বাস করতে পারছিল না। দূর থেকে ধোঁয়ার একটা সাদা মেঘ আসতে দেখা গেল, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন একটা পুরনো কালো ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে থামল। ট্রেনটার চেহারা দেখে মনে হলো এটা প্রাচীন আমলের, যেন সময়ের অনেকটা আগের একটা ট্রেন হঠাৎ করে ফিরে এসেছে। ভেতরে বাতি জ্বলে আছে, কিন্তু জানালাগুলো থেকে একটিও যাত্রী দেখা যাচ্ছে না।


সৌরভ থমকে দাঁড়াল। তার মনে ভয় জন্মাতে লাগল। সে ভাবল, “আমার কি এই ট্রেনে উঠা উচিত?” তারপর নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে ভাবল, “এটা হয়তো পুরোনো মডেলের ট্রেন, হয়তো কোনো বিশেষ ব্যবস্থায় চালানো হচ্ছে।” সে ধীরে ধীরে ট্রেনের দরজার কাছে গেল। দরজা খুলে গেল স্বয়ংক্রিয়ভাবে, এবং ভেতরে ঢুকতেই যেন তার শরীরে কাঁপুনি লাগল।


ভেতরে ঢুকে সে দেখল, ট্রেনের প্রতিটি কামরা ফাঁকা। শুধু একটা সীটে একটা জীর্ণ চাদর ছড়ানো। সবগুলো জানালায় ধুলা জমে আছে, এবং মেঝেতে পড়ে আছে কয়েকটা ছেঁড়া কাগজের টুকরো। সে একটা সিটে বসে পড়ল, কিন্তু তার মন একদমই শান্ত হতে পারছিল না। ট্রেনটা চলতে শুরু করল, এবং আস্তে আস্তে গতিও বাড়ল।


ট্রেনের ভেতরের বাতাসে একটা গন্ধ ছিল, যেন অনেক পুরনো কাঠ আর মরিচার গন্ধ। হঠাৎ করেই ট্রেনের বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলা শুরু করল। সৌরভ তাকিয়ে দেখল, আরেকটা কামরায় যেন কারো ছায়া দেখা যাচ্ছে। তার বুক ধুকধুক করতে লাগল। কে হতে পারে? ট্রেন তো সম্পূর্ণ ফাঁকা ছিল! সে সাহস করে ওই কামরার দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না। যেন ছায়াটাও মিশে গেছে।


হঠাৎই, ট্রেনের গতি থেমে গেল। সৌরভ জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, ট্রেন একটা অন্ধকার টানেলের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, যেন আলো সেখানে পৌঁছায় না। ট্রেনটা চলা বন্ধ করার পর থেকে চারপাশটা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই, একটা ঠাণ্ডা হাত তার কাঁধে পড়ল।


সে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল, কিন্তু কেউ নেই। তার চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। তার মনে হলো কেউ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ করেই ট্রেনের আলো বন্ধ হয়ে গেল, আর সব অন্ধকারে ঢেকে গেল। তার চারপাশে শুধু শোনা যাচ্ছে ট্রেনের চাকাগুলোর কর্কশ আওয়াজ আর অদ্ভুত ফিসফিস শব্দ।


সৌরভ চিৎকার করে উঠতে চাইল, কিন্তু গলা থেকে আওয়াজ বের হচ্ছিল না। তখন হঠাৎই একটা কণ্ঠ শোনা গেল, ফিসফিস করে বলছে, “তুমি এখানে কীভাবে এলে? এই ট্রেনে যারা একবার ওঠে, তারা আর কখনো ফিরে যেতে পারে না।”


সে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে সিটে বসে পড়ল। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কিভাবে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবে। সে কাঁপা গলায় বলল, “আমি শুধু ট্রেনে চড়ে বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম।” তখন সেই অদৃশ্য কণ্ঠটি আরও একটা কথা বলল, “এই ট্রেনে যারা ওঠে, তাদের আত্মা এই ট্রেনের সঙ্গে চিরতরে যুক্ত হয়ে যায়। তুমিও তার ব্যতিক্রম নও।”


হঠাৎ করেই ট্রেনটা আবার চলা শুরু করল, তবে এবার গতি আরও বেশি। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সৌরভ দেখতে পেল, ট্রেনটা যেন কোনো সাধারণ পথ দিয়ে চলছে না। চারপাশে অদ্ভুত ছায়াময় গাছপালা, আর দিগন্তজুড়ে কুয়াশায় মোড়া। সে বুঝল এটা কোনো সাধারণ ট্রেন নয়, বরং একধরনের ভৌতিক ট্রেন যা বাস্তবের থেকে ভিন্ন এক জগতে চলে এসেছে।


ট্রেনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন আরও বেশি অস্বাভাবিক হয়ে উঠছিল। কিছুক্ষণ পর ট্রেনটা হঠাৎ থেমে গেল। সৌরভ জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, একটা অন্ধকারময় স্টেশন। স্টেশনের নামফলকটা পড়ে দেখা গেল, সেটাতে লেখা “মৃত্যুর দ্বার”। তার শরীর শিউরে উঠল।


সে যখন ট্রেন থেকে নামতে চেষ্টা করল, তখন সেই অদৃশ্য কণ্ঠটা বলল, “তুমি আর এই ট্রেন থেকে নামতে পারবে না। এখানে যারা আসে, তারা এখানে চিরকাল থাকে।”


তারপর থেকে সৌরভের কোনো খোঁজ আর কেউ পেল না। মানুষ বলে, মাঝে মাঝে নির্জন সেই স্টেশন থেকে রাতের দিকে ট্রেনের আওয়াজ শোনা যায়। যারা সাহস করে সেই ট্রেনে চড়তে যায়, তাদের আর কখনো ফিরে আসা হয় না। তাদের আত্মা সেই ট্রেনের কামরাগুলোর মাঝে বন্দী হয়ে চিরকাল ঘুরতে থাকে, একটি ভৌতিক যাত্রার শেষ না হওয়া পথের খোঁজে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ