কোথাও কেউ নেই কলকাতার এক নির্জন বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা। ঘড়িতে রাত সাড়ে দশটা। শহরের কোলাহল স্তিমিত হয়ে এসেছে, রাস্তাঘাটে টিপটিপ করে বৃষ্টির ধারা ঝরছে। ঠিক সেই সময়ে পুলিশের একটি ফোন আসে কেসের অভিজ্ঞ গোয়েন্দা আরিফ চৌধুরীর কাছে। কলকাতার উপকণ্ঠের এক অভিজাত এলাকায়, এক ধনী ব্যবসায়ী প্রদীপ সেনগুপ্ত খুন হয়েছেন। ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর নির্দেশ পাওয়ামাত্রই আরিফ দ্রুত তার কোট গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরিফ পৌঁছে গেলেন প্রাসাদসম সেই বিশাল বাড়িতে। বাড়িটির চারপাশে পুলিশের ঘেরাটোপ। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে তিনি দেখতে পেলেন প্রদীপ সেনগুপ্তের নিথর দেহ, তাঁর নিজস্ব লাইব্রেরি রুমে পড়ে আছে। মেঝেতে এক ফোঁটা রক্ত নেই, শুধু প্রদীপের শরীরে চিরে যাওয়ার চিহ্ন। গোয়েন্দা আরিফ চোখ বুলিয়ে নিলেন পুরো ঘরে। সবকিছুই ঠিকঠাক, কোনো কিছু এলোমেলো নয়। অদ্ভুতভাবে সাজানো একটি ঘর, যেন মৃত্যু আগে থেকেই পরিকল্পিত। প্রদীপ সেনগুপ্তের প্রাসাদে সেই সময়ে উপস্থিত ছিলেন চারজন: প্রদীপের স্ত্রী অনিতা, তার একমাত্র ছেলে নীল, ব্যক্তিগত সহকারী কৌশিক, এবং বাড়ির কাজের মেয়ে মিতালি। প্রত্যেকেরই দাবি, তারা একা ছিল। কিন্তু আরিফ জানেন, সবাই যদি একা থাকে, তবে খুনটা করল কে? তাই তিনি প্রত্যেককে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অনিতা, তার পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সী, স্বামীর মৃত্যুর পরও যেন চুপচাপ বসে আছেন। আরিফ তার কাছে জানতে চাইলেন, “ঘটনার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?” অনিতা কিছুটা বিচলিত হয়ে বললেন, “আমি তখন আমার ঘরে ছিলাম, প্রদীপ রাতে কখনো লাইব্রেরিতে একা সময় কাটাতে পছন্দ করত। আমার কিছু সন্দেহ হয়নি।” আরিফ অনিতার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে দেখলেন, কিন্তু তার মুখে যেন কোনো আবেগ নেই। একটু ম্লান হাসি দিয়ে তিনি বললেন, “বেশ, আপনি যেতে পারেন।” নীল, ছোটোখাটো এক যুবক, বাবার মৃত্যুর খবর শুনে যেন অস্থির। আরিফ জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বাবা লাইব্রেরিতে গেলেন, তুমি কি জানো কেন?” নীল হালকা হেসে বলল, “বাবা তো নিয়মিতই লাইব্রেরিতে সময় কাটাত। আমি তখন আমার ঘরে একা গান শুনছিলাম।” আরিফের নজরে নীলের সেই ম্লান হাসি ধরা পড়ল। নীল কি লুকাচ্ছে? ব্যক্তিগত সহকারী কৌশিক, যে বরাবরই প্রদীপের সব কাজ দেখাশোনা করত। আরিফ জানতে চাইলেন, “ঘটনার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?” কৌশিক বলল, “আমি তখন আমার ঘরে কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আমার কিছু জানা নেই।” আরিফ তার দিকে গভীর নজরে তাকালেন। কৌশিকের কণ্ঠে স্বাভাবিকতা থাকলেও তার মুখে একধরনের অস্বস্তি স্পষ্ট। কাজের মেয়ে মিতালি ভীতসন্ত্রস্ত। আরিফ তাকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি কিছু দেখেছ?” মিতালি একটু অস্থিরভাবে উত্তর দিল, “না স্যার, আমি তখন রান্নাঘরে ছিলাম।” আরিফের মনে হল, মিতালি কিছু লুকাচ্ছে। কিন্তু সে আর প্রশ্ন করেননি। প্রত্যেকেই একা ছিল, কিন্তু তা কি সত্যি? আরিফ পুরো বাড়ি ঘুরে দেখলেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যেকটি ঘরের করিডোর, সিঁড়ি, এবং ঘরের মধ্যে ছোট ছোট জিনিস খেয়াল করলেন। তাঁর অভিজ্ঞ চোখ যেন একটা ক্ষুদ্র ইঙ্গিতও এড়ায় না। হঠাৎই তার চোখ পড়ল লাইব্রেরির দরজার ঠিক নিচে। মেঝেতে লাল রঙের এক অদ্ভুত ফোঁটা, যা দেখে রক্তের মতোই লাগছে। এটি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন যে এটা রক্ত। কিন্তু ঘটনা এখানেই থেমে থাকল না। তিনি দেখলেন লাইব্রেরির জানালার পাশের একটি ফুলদানিতে কিছু ফুল এলোমেলোভাবে রাখা, যা দেখে মনে হল ফুলগুলো অল্পক্ষণ আগেই সরানো হয়েছে। আরিফের মনে সন্দেহ দানা বাঁধল। এ ঘটনায় আরও কিছু আছে। তিনি সবার কক্ষে আবার প্রবেশ করলেন এবং কিছু বিশেষ প্রশ্ন করলেন। আরিফ যখন দ্বিতীয়বারের মতো নীলকে প্রশ্ন করতে গেলেন, তখন নীল একটু নার্ভাস হয়ে উঠল। আরিফ তাকে প্রশ্ন করলেন, “তোমার বাবা মারা গেলেন, তোমার মনে হয় না তার জন্য তুমি একটু বেশি সময় ব্যয় করা উচিত ছিল?” নীল এবার মুখ ফসকে বলে ফেলল, “আমি চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু...” তারপর চুপ হয়ে গেল। আরিফ তাকে আরও চেপে ধরলেন, এবং তখনই সে স্বীকার করল, বাবার সঙ্গে তার একদিন আগে ঝগড়া হয়েছিল। তার বাবা ব্যবসার উত্তরাধিকার তাকে দিতে চাইছিলেন না, বরং কৌশিককেই সেই দায়িত্ব দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আরিফ জানেন, শুধুমাত্র সন্দেহের উপর ভিত্তি করে খুনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। একদিন পরে, আরিফ ফিরে এলেন একটা কাগজের খোঁজ নিয়ে, যা তার ধারণা অনুযায়ী খুনের কারণ। তদন্তে বেরিয়ে এল যে প্রদীপের ইচ্ছাপত্রে সমস্ত সম্পত্তি নীলের নামেই ছিল, কিন্তু প্রদীপ তা পরিবর্তন করে যাচ্ছিলেন। কৌশিক এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার সাক্ষী ছিল। তাই আরিফ বুঝলেন, কৌশিকই এই খুনের সাথে জড়িত। কৌশিকের মুখোমুখি এসে আরিফ বললেন, “আপনি সত্যিটা স্বীকার করুন, কৌশিক। আমরা জানি, এই পরিবর্তনের বিষয়টি আপনি জানতেন।” কৌশিক একসময় স্বীকার করে নিলেন, “হ্যাঁ, আমি জানতাম। কিন্তু নীল আমাকে খুনের বিষয়ে বলেছিল, আমি ভাবিনি সে এতদূর যাবে।” এই বলে কৌশিকও চুপ হয়ে গেল। গোয়েন্দা আরিফ চুপচাপ শুনে গেলেন। তিনি বুঝলেন, এই বাড়ির প্রতিটি মানুষেরই কিছু না কিছু লুকানোর প্রবণতা রয়েছে। তার দৃষ্টি এবার অনিতা আর মিতালির দিকে গেল। কিন্তু তারা তখনও চুপ। সত্যিই তো, "কোথাও কেউ নেই" - অথচ প্রত্যেকেই ঘটনায় জড়িত ছিল। |
0 মন্তব্যসমূহ