গুম হয়ে যাওয়া শিশু |
শান্তিপূর্ণ ছোট্ট পাহাড়ি শহর কল্পগঞ্জ, যেখানে জনসংখ্যা খুব বেশি না হলেও মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যের অভাব ছিল না। শহরের প্রতিটি মানুষ একে অপরকে চিনতো, আর তাদের জীবনযাপন ছিল প্রায় নির্ভুল শান্তিতে ঘেরা। একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই শহরের সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল শিশু অয়ন নিখোঁজ হয়ে গেল।
অয়ন ছিল সকলের প্রিয়। ছোটবেলা থেকেই তার মিষ্টি হাসি আর চঞ্চল স্বভাব সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। শহরের প্রতিটি মানুষ তার উপর স্নেহ বর্ষণ করতো। তার হাসির শব্দ যেন গোটা শহরের রঙিনতা ছিল। কিন্তু সেই হাসির শব্দ শহর থেকে হারিয়ে গেল যখন হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় সবাই লক্ষ্য করল, অয়ন আর বাড়িতে নেই। মা-বাবা ছুটে ছুটে সারা শহরে খুঁজে বেড়ালেন, কোথাও খুঁজে পেলেন না তাকে।
প্রথম দু’এক দিন শহরের মানুষজন তাকে খোঁজার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করল। পুলিশকে খবর দেওয়া হলো, আর পুরো শহর জুড়ে পোস্টার লাগানো হলো। সবাই ধরে নিয়েছিল, হয়তো কোনো বনে কিংবা নদীর ধারে গিয়ে পথ হারিয়েছে ছোট্ট ছেলেটি। কিন্তু দিন কেটে যাওয়ার পরেও তার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। অয়নের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ধীরে ধীরে এক রহস্যে পরিণত হতে লাগল। শহরের কিছু মানুষ বলতে শুরু করল, অয়নকে কেউ দেখেছে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে, আবার কেউ বলল, রাতে তার কণ্ঠস্বর শুনেছে। কিন্তু এইসব গল্প যতই ছড়াতে লাগল, এক অদ্ভুত ঘটনা শহরবাসী লক্ষ্য করল—প্রত্যেকবার যখন কেউ অয়নের নাম বলত, কিছুক্ষণের মধ্যে তারা সেই নামটি ভুলে যেত। প্রথমে সবাই ভেবেছিল এটা একটা সাধারণ ভুল। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল, কেউ অয়নের নাম উচ্চারণ করার পর মুহূর্তেই তার নাম মনে করতে পারছে না। একজন তার নাম বলতে গেলেই জিভ আটকে যেত, মনে পড়া সত্ত্বেও মুখে আনতে পারত না সেই নাম। এমনকি অয়নের মা-বাবাও একসময় তার নাম মনে করতে পারছিলেন না। এক বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন তারা, চোখের জল ঝরাতে ঝরাতে ভাবতেন, তাদের সন্তানের নামটা কী ছিল? দিন যেতে লাগল, কিন্তু অয়নের স্মৃতি এক অদ্ভুত কুয়াশায় ঢেকে যেতে লাগল। শহরের মানুষরা অয়নের সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যেত। কেউ মনে করতে পারত না ঠিক কোন ছেলে ছিল সে, কেমন দেখতে ছিল। শহরের প্রতিটি গলির প্রতিটি বাড়ি অয়নের পদচারণায় চেনা ছিল, কিন্তু এখন যেন সেই স্মৃতি মুছে যেতে বসেছে। তবুও কিছু লোক সাহস করে তার নাম মনে করার চেষ্টা করল। একদিন গ্রামের প্রাচীন ইতিহাসবিদ মুকুন্দ বাবু চেষ্টা করলেন অয়নের নাম মনে করতে। কিন্তু নামটি তার মনে এলেই তিনি যেন ভুলে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর হঠাৎ মুকুন্দ বাবু তার নিজের নামও ভুলে গেলেন। তার পরিবার আর প্রতিবেশীরা সবাই তাকে চিনলেও মুকুন্দ বাবু বুঝতে পারলেন না তিনি কে। **বিষয়টির গভীরে যাওয়ার চেষ্টা** একজন লেখক এবং গবেষক অনিন্দ্য বিশ্বাস এই ঘটনাটি শোনার পর কল্পগঞ্জে এলেন। তিনি এই ধরনের অদ্ভুত ঘটনায় গবেষণা করেন। শহরের লোকেরা যখন তাকে ঘটনাটি বলল, তখন তিনি বুঝতে পারলেন, এখানে কিছু অলৌকিক ঘটছে। তিনি ঠিক করলেন, প্রতিটি মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, আর সেই বাচ্চাটির অতীত সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবেন। কয়েকজন প্রবীণ লোক তাকে জানালেন, এই শহরে আগে কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি। তারা প্রত্যেকেই অয়নকে একসময় খুব ভালোভাবে চিনতেন, কিন্তু আজ তার সম্পর্কে কোনো স্মৃতিই আর পরিষ্কার নয়। অনিন্দ্য ভাবলেন, এই রহস্যের একটাই সমাধান আছে—অয়নের নামটি মনে করতে পারলেই হয়তো এই অভিশাপ ভাঙা সম্ভব। অনিন্দ্য রাতের আঁধারে একা একা সেই স্থানটি খুঁজে বের করলেন, যেখানে কেউ শেষবার অয়নকে দেখেছিল। রাত তখন প্রায় গভীর, পাহাড়ের গায়ে হিম শীতল বাতাস বইছে। গাছের পাতা সড়সড় শব্দ করে নড়ছিল, আর হঠাৎ করেই একটা ছায়া যেন তার পেছনে দেখা দিল। অনিন্দ্য চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন, একটি ছোট্ট মেয়ের মতো ছায়ামূর্তি তাকে ইশারায় কাছে ডাকছে। ছোট্ট মেয়েটি কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “অয়নের নাম যদি কেউ মনে করতে পারে, তবে সে আবার ফিরে আসবে। কিন্তু তার নাম মনে করার পর কেউ নিজেকে ভুলে যাবে।” অনিন্দ্য ভয়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন, কিন্তু সাহস করে বললেন, “তাহলে কি আমি তার নাম মনে করতে পারব?” মেয়েটি বলল, “অয়নের নাম মনে করতে পারলে তার আত্মা মুক্তি পাবে, কিন্তু তোমার নিজের স্মৃতি হারিয়ে যাবে।” অনিন্দ্য তখন দুটো পথের মধ্যে দ্বিধায় পড়লেন। তিনি জানেন, অয়নের আত্মাকে মুক্তি দেওয়া তার দায়িত্ব, কিন্তু নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলতে তিনি প্রস্তুত কিনা, সেটা ভাবতে লাগলেন। কিছুক্ষণ গভীর চিন্তা করার পর, তিনি স্থির করলেন, নিজের স্মৃতি হারিয়েও এই অভিশাপ ভাঙবেন। অনিন্দ্য এক গভীর শ্বাস নিলেন এবং ধীরে ধীরে অয়নের নাম মনে করতে শুরু করলেন। তিনি অনুভব করলেন, তার স্মৃতিতে একটা ধোঁয়াশা জমতে শুরু করেছে। অয়নের নাম ঠিকমতো মনে হতেই তার নিজের স্মৃতি ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গেল, নিজের নামটাও আর মনে করতে পারলেন না। পরদিন সকালে, শহরের মানুষ দেখল, একটি ছোট্ট শিশু গ্রামের রাস্তা ধরে হেঁটে আসছে। সবাই অবাক হয়ে তাকাল, সেই শিশু তো অয়ন! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, শহরের কেউই আর অয়নের নাম ভুলে যাচ্ছে না। অন্যদিকে, অনিন্দ্যকে আর কেউ খুঁজে পেল না। তার স্মৃতির খাতায় কেউ তাকে খুঁজে পায় না, তার পরিচয় মুছে গেছে চিরতরে। শহরের মানুষ জানে, এক অজানা আত্মত্যাগের ফলে তারা আজ এক শিশুর নাম স্মরণ করতে পারে। এখনও শহরের মানুষ মাঝেমাঝে একা একা রাস্তা দিয়ে হাঁটলে কেউ কেউ শোনা যায় ফিসফিস করে একটা কণ্ঠ বলে, “অয়ন.. ” কিন্তু সেই কণ্ঠ যে অনিন্দ্যর, তা কেউ মনে করতে পারে না। |
0 মন্তব্যসমূহ