হাসপাতালের রাতের প্রহরী |
শহরের প্রান্তে অবস্থিত সেই পুরোনো হাসপাতালটির কথা প্রায় সবাই জানে। হাসপাতালের বেশিরভাগ অংশ আধুনিকীকরণ করা হলেও, একটি পুরোনো ওয়ার্ড বছরের পর বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে। নতুন কেউই সেখানে ঢোকে না, কারণ সবাই জানে সেই ওয়ার্ডের চারপাশে একটা অদ্ভুত নীরবতা ঘিরে থাকে। স্থানীয়রা বলে, ওই ওয়ার্ডে একসময় অনেক রোগী হঠাৎ হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যেতো। তবে সেই রহস্যের কোনো সমাধান হয়নি, আর কর্তৃপক্ষও সেই ঘটনাগুলোর দিকে গুরুত্ব দেয়নি।
রাতের প্রহরী শামসু বেশ কিছুদিন ধরে এই হাসপাতালেই কাজ করছে। বেশিরভাগ সময় রাত কাটে রোগীদের কাছ থেকে খবর নেয়া, কখনও জরুরি ডিউটি, আবার কখনও অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে সহযোগিতা করা। তবে সবচেয়ে ভয়ের কথা, মাঝেমাঝে সেই বন্ধ ওয়ার্ডের দরজার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে হয় তাকে। প্রতিবারই সেখানে একটা শীতল অনুভূতি হয়, যেন কেউ ওখানে তাকিয়ে আছে।
এক রাতের কথা, শীতল বাতাসে গা ছমছম করছিল। শামসু চা খেয়ে একটু জিরোতে যাচ্ছিল, তখনই তার ওয়াকিটকিতে শব্দ হলো। জরুরি ডাক এসেছে সেই বন্ধ ওয়ার্ডের দিক থেকে। শামসুর ভেতরে কেমন এক অজানা ভয় জন্মালো। ওয়ার্ডটা তো বহুদিন ধরে বন্ধ, ওখানে তো কেউ যাওয়ার কথা নয়। তবুও কৌতূহল বশত সে এগিয়ে গেল।
দরজার কাছে গিয়ে দেখলো, মেঝেতে একটা পুরোনো চেয়ার পড়ে আছে, চারদিকে ধুলো জমে আছে, আর দরজার ফাঁক দিয়ে একধরনের শীতল বাতাস বের হচ্ছে। মনে হলো কেউ ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুত পেছনে ফিরে তাকাতেই শামসুর মাথায় হাত পড়ল। কেউ নেই। তবে দরজা থেকে একটা অদ্ভুত সাদা আলো বের হচ্ছিল, আলোটা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গেল। যেন কেউ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে।
পরের দিন শামসু সাহস করে সুপারভাইজারকে সব জানালো। সুপারভাইজার তার কথা বিশ্বাস করতে চাইলেন না। তবে শামসুর অনুরোধে পরের রাতেও সেই বন্ধ ওয়ার্ডের কাছে যাওয়া হলো। কিন্তু কোন আলোর ছিটেফোঁটাও নেই, সবই অন্ধকার। কিছুক্ষণ পর, সুপারভাইজার বললেন, “কেমন ফালতু কথা বলছো! কিছুই তো দেখছি না!” শামসু তখনও নিশ্চিত ছিল যে, ওয়ার্ডের ভেতরে কিছু একটা আছে, তবে সেটা দেখানোর মতো সাহস তার হয়নি।
কিছুদিন পর, শামসু আবার রাতে ডিউটি করছিল। প্রায় মাঝরাতের দিকে হঠাৎ আবারও সেই বন্ধ ওয়ার্ড থেকে আওয়াজ আসতে লাগল, যেন কেউ ধাক্কা মারছে। শামসু আর দেরি করল না, সে টর্চ নিয়ে দ্রুত সেই ওয়ার্ডের দিকে এগোল। দরজার সামনে এসে দেখলো দরজার নীচ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে আসছে। সে ভয়ে পেছাতে শুরু করলো, কিন্তু পা যেন চলছিল না। ভয়ে হাত-পা কাঁপছিল তার।
বাধ্য হয়ে সে ওয়ার্ডে ঢুকল। ভেতরে ঢুকেই দেখলো, মেঝেতে একটা লম্বা কঙ্কাল পড়ে আছে। মনে হলো, সেটা কারও একসময়কার দেহাবশেষ। চারপাশে মৃদু আলো জ্বলছিল, দেয়ালে অদ্ভুত ছায়া পড়ছিল। শামসু যেন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ দেখল দেয়ালের একদিকে রক্ত দিয়ে লেখা আছে: **“আমাদের মুক্তি দাও।”**
শামসু বুঝে উঠতে পারছিল না, কিন্তু তার মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা গল্প ঘুরে বেড়াতে শুরু করল। বহু বছর আগে এই ওয়ার্ডে মানসিক রোগীদের আটকে রাখা হত, এবং শোনা যায় যে কয়েকজন রোগীকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দেওয়া হয়েছিল। তাদের পরিবার কখনও জানতে পারেনি যে, তাদের আপনজনকে কত নির্মমভাবে ফেলে রাখা হয়েছিল এখানে। সেই রোগীদের আত্মা আজও এখানেই রয়ে গেছে, আর তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই ওয়ার্ডটাকে বন্ধ করে রেখেছে।
শামসু দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পরের দিন, সে কর্তৃপক্ষের কাছে ওই কঙ্কালের বিষয়ে জানাল। প্রথমে কেউ বিশ্বাস করেনি, তবে শামসু জোরাজুরি করায় পুলিশকে খবর দেওয়া হলো। পুলিশ এসে খনন কাজ চালিয়ে আরো অনেক কঙ্কাল খুঁজে বের করল, যা দেখে হাসপাতালের কর্মকর্তারা চমকে উঠল। আসলেই বহু রোগীকে একসময় এই হাসপাতালে বন্দী অবস্থায় নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।
এই ঘটনার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঐ ওয়ার্ডকে চিরতরে সিল করে দিল। কিন্তু শামসু জানতো, ওয়ার্ড সিল করা সম্ভব হলেও, সেই আত্মাদের মুক্তি দেওয়া সম্ভব নয়। সে আজও রাতের প্রহরী হিসেবে কাজ করে, তবে কখনও আর ওই ওয়ার্ডের কাছে যায় না। তার মনের গভীরে সেই একটিই প্রশ্ন থেকে গেছে: “যদি তাদের সত্যিই মুক্তি দেওয়া যেত?”
আর এই রহস্যের পেছনে থাকা এক নির্মম ইতিহাস আজও হাসপাতালের দেয়ালে শীতল বাতাসের মতো বয়ে বেড়াচ্ছে।
0 মন্তব্যসমূহ