চোখের কোণ -

চোখের কোণ - Chokher kon - Story Bangla - স্টোরি বাংলা -
চোখের কোণ

সিমরনের জীবনে সবকিছুই ছিল খুব সুন্দর। তার সুখের সংসার, একটি সুন্দর ঘর, আর দারুণ বন্ধু-বান্ধব। কিন্তু একদিন, এক অদ্ভুত ঘটনা তার জীবনকে পরিবর্তন করে দিল। সিমরন, যে কিনা একজন সফল পেশাদার মহিলা, তার চাকরির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হঠাৎ করে অস্বস্তি অনুভব করতে শুরু করে। অফিসে কাজ করার সময় মাঝে মাঝে তার চোখের কোণে কিছু একটি ছায়া দেখা যেত। কিন্তু যখনই সে সেটির দিকে তাকাত, কিছুই দেখা যেত না। প্রথমে সে এটিকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। কিন্তু দিন যত এগোচ্ছিল, সেই অনুভূতি যেন ততই ভয়াবহ হয়ে উঠছিল।


দিনের পর দিন, অফিসে কাজ করার সময় সিমরন বারবার সেই ছায়ার উপস্থিতি অনুভব করতে লাগল। সে শূন্যতা অনুভব করত, যেন কেউ তার চারপাশে ঘুরছে, কিন্তু যখন সে ঘুরে তাকাত, সবকিছু নিঃসঙ্গ আর শান্ত। এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা তার মাথায় একটা চাপ তৈরি করতে লাগল। শেষে সে একদিন তার সহকর্মী অর্পিতার কাছে বিষয়টি খুলে বলল।


অর্পিতা, আমি কিছু অদ্ভুত অনুভব করছি,” সিমরন বলল। “আমি মনে হচ্ছে, কেউ আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু যখনই আমি ঘুরে তাকাই, কেউ নেই।”


অর্পিতা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি নিশ্চিত? হয়তো তোমার একটু চাপ আছে। কাজের চাপে হয়তো মনে হচ্ছে।”


কিন্তু সিমরনের মন থেকে এই চিন্তা যায় না। সে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে লাগল। সে বুঝতে পারছিল, এর পেছনে কিছু একটা আছে। অফিস থেকে ফিরে এসে তার বাড়ির কোণায়, জানালায়, প্রতিটি স্থানে সে সেই ছায়ার অস্তিত্ব অনুভব করছিল।


এভাবে কয়েক সপ্তাহ কাটতে থাকল। সিমরন একদিন একটি পুরনো ছবি খুঁজতে গিয়ে তার দাদির একটি ছবি দেখতে পেল। ছবিতে তার দাদি একটি খুব সুন্দর গাউন পরে রয়েছেন এবং তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন একটি মেয়ের ছায়া। সিমরনের হৃদয়ে যেন কোনো অদ্ভুত অনুভূতি হল। এই মেয়েটির চোখে ছিল এক অদ্ভুত আলো, যা সিমরনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সিমরন সিদ্ধান্ত নিল, সে এই মেয়েটির পরিচয় খুঁজবে।


এক সন্ধ্যায়, সিমরন তার দাদির পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে গেল। তাদের মধ্যে একজন বুড়ো মহিলা বললেন, “তুমি কি জানো, তোমার দাদির জীবনেও একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল?”


সিমরন বিস্ময়ে শুনতে লাগল। বুড়ি মহিলা বললেন, “তোমার দাদি একটি দুর্ঘটনায় মারা যান। কিন্তু মৃত্যুর পরেও সে আমাদের মধ্যে ছিল। সে একটা মেয়ের ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়াত। সেই মেয়েটির জীবনে কিছু অপরাধ ছিল, এবং সে দাদির সাহায্য চেয়েছিল।”


সিমরন আঁতকে উঠল। “কিন্তু, কেন আমার কাছে আসছে?”


সম্ভবত, সে তোমার সাহায্য চাচ্ছে,” বুড়ি মহিলা বললেন।


সিমরন বাড়ি ফিরে আসার পর আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। রাতে বিছানায় শুয়ে সে ছায়াটিকে ভয়াবহভাবে দেখতে পেয়েছিল। সে যেন বুঝতে পারছিল, ছায়াটি কেবল একটি কল্পনা নয়, বরং একটি আত্মার অস্তিত্ব।


এরপর থেকে সিমরন সিদ্ধান্ত নিল, সে এই ছায়ার পেছনের সত্যি খুঁজে বের করবে। সে স্থানীয় গ্রন্থাগারে গেল এবং তার দাদির সময়ের ইতিহাস খুঁজতে লাগল। সেখানে সে জানতে পারল, সেই মেয়েটির নাম ছিল রিয়া। রিয়া একটি অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিল, কিন্তু তার জীবন একটি অন্ধকার রহস্যের শিকার ছিল।


রিয়ার পরিবারের বিরুদ্ধে একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, যার ফলে তাকে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে হয়। কিন্তু রিয়া কোনো আত্মীয় বা বন্ধু না পেয়ে নির্যাতিত হয়ে মারা যায়। সিমরন অনুভব করল, রিয়ার অশান্ত আত্মা এখনও শান্তি পায়নি, এবং তার দায়িত্ব হলো তাকে মুক্তি দেওয়া।


সিমরন তখন একটি পূর্ণিমার রাতে, যেখানে তিনি রিয়ার স্মৃতি নিয়ে একটি পূর্ণিমার রাত্রে এসে উপস্থিত হন। তিনি মনে মনে বললেন, “রিয়া, আমি জানি তুমি এখানে আছো। আমি তোমার কষ্ট বুঝি। আমি তোমাকে মুক্তি দিতে চাই।”


তিনি রিয়ার ছায়াটিকে ডেকে নিয়ে আসলেন। সেই রাতে, সিমরন রিয়ার আত্মার জন্য প্রার্থনা করলেন এবং তার কষ্টের মুক্তির জন্য কামনা করলেন। তার চোখে অশ্রু ছিল, কিন্তু সেই অশ্রুতে শান্তি ছিল।


হঠাৎ করে বাতাসে এক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটল। রিয়ার ছায়াটি ধীরে ধীরে সিমরনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। সিমরন অনুভব করল, রিয়া এখন শান্তিতে আছে। সে বুঝতে পারল, রিয়ার প্রয়োজন ছিল কাউকে তার কষ্ট বোঝার জন্য, কাউকে যে তাকে মুক্তি দিতে পারে।


এরপর থেকে, সিমরন আর কখনোই সেই ছায়াটিকে অনুভব করেনি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কখনো কখনো আমাদের আশেপাশে থাকা অদ্ভুত জিনিসগুলোই আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন।


সিমরন ফিরে গেল তার জীবনে, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা তাকে একটি নতুন শিক্ষায় নিয়ে এল। সে বুঝল, আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা মাঝে মাঝে অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু তাদের পেছনে অনেক গভীর অর্থ থাকতে পারে। রিয়ার মুক্তির মাধ্যমে সে শুধু তার জীবনের একটি অধ্যায় শেষ করেনি, বরং নতুনভাবে জীবনযাপন শুরু করেছে।


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ