মর্গের অনন্ত রাত

 

মর্গের অনন্ত রাত

শহরের এক কোনায় অবস্থিত একটি পুরনো হাসপাতালের মর্গ, যা বছরের পর বছর ধরে মৃত্যুর নিস্তব্ধতা বয়ে বেড়াচ্ছে। দিনের আলো পড়ার সাথে সাথে মর্গের আশেপাশে কিছু একটা যেন বদলে যায়। রাতের অন্ধকারে এখানে এক ধরনের অজানা শীতলতা অনুভূত হয়। বছরের পর বছর ধরে এখানে কাজ করা কর্মচারীরাও রাতের শিফটে কাজ করতে গেলে মনঃসংযোগ হারায়। কেউ কেউ বলে মর্গের ভেতরে গভীর রাতের পর অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটে। লাশগুলো যেন নিস্তব্ধতার মধ্যে নিজেই কথা বলে, এবং সেই কণ্ঠগুলো কেবল রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেয়।

মর্গের এক কর্মচারী ছিলো অনিমেষ। সে বেশ কয়েক বছর ধরে এখানে কাজ করছে এবং প্রতিদিনই একই নিয়মে লাশ সংরক্ষণ এবং পরিচর্যা করে। তার মনে ছিল মর্গের এই অদ্ভুত ঘটনা নিয়ে কোনো সংশয়, কিন্তু এক রাতে যা ঘটেছিল তা তার জীবনের সমস্ত বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়।

সেই রাত ছিল বিশেষ। রাত তখন প্রায় ১টা। একঝাঁক মেঘ ছেয়ে আছে আকাশে, কোনো চাঁদের আলো নেই, হাসপাতালের বাকি অংশ নিস্তব্ধ, কেবল মর্গের কক্ষগুলিতে একটি ম্লান আলো জ্বলছে। সেই রাতে একটা লাশ আসতে দেরি হয়েছিল। একজন বৃদ্ধ মানুষ, যার মুখ ছিল চুপসে যাওয়া এবং চোখ খোলা। অস্বাভাবিক কিছু নয়, তবে কেমন যেন একটা শীতলতার আভাস ছিল সেই মৃতদেহে। অনিমেষ সেই লাশটিকে একটা পুরনো বিছানায় রেখে রাখল, তার কাজ শেষ করে বেরোনোর সময় হল।

কিন্তু ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পেল। প্রথমে সে ভাবল হয়তো বাতাসের শব্দ, কিন্তু শব্দটি ক্রমশ বাড়তে লাগল। মর্গের অন্য লাশগুলো ছিল একদম স্থির, কিন্তু হঠাৎই সেই খোলা চোখওয়ালা বৃদ্ধ লাশটি যেন একটু নড়ে ওঠে। অনিমেষ প্রথমে ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু নিজেকে সাহস দিলো—এটি কেবল মানসিক বিভ্রম, কিছুই নয়।


কিছুক্ষণ পরেই, এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। মর্গের মেঝেতে একটি লাশ হঠাৎই পড়ে গেল, নিজে নিজেই নড়তে লাগল। অনিমেষ এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেল। সে ভাবল হয়তো কোনো রকম বিপত্তি ঘটেছে, কিন্তু নিজের চোখের সামনেই যখন লাশগুলো আস্তে আস্তে নড়তে শুরু করল, তখন তার মন আতঙ্কে জমে গেল।


সে আবার সেই খোলা চোখওয়ালা লাশটির দিকে তাকিয়ে দেখে, চোখ দুটো যেন তাকে সরাসরি দেখছে। এক ধরনের অদ্ভুত শূন্যতা আর অভিশপ্ত দৃষ্টি যেন তাকে ঘিরে ধরে আছে। কেমন এক ঘন কালো অন্ধকার তাকে ঘিরে ধরে।

ঘরের বাতাস ক্রমে ভারী হতে লাগল। দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গেল একে একে, মর্গের মূল দরজাটি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ, এবং ভেতরের অন্ধকার আরও ঘন হতে লাগল। সে দেখল মেঝেতে পড়ে থাকা লাশটি উঠে দাঁড়িয়েছে এবং ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। অনিমেষ জানে এখানে কিছু একটা ভুল হচ্ছে, তবে তার হাত-পা জমে গেছে, আর সে কিছুতেই পালাতে পারছে না। সেই লাশের চোখে ছিল এক প্রচণ্ড ক্ষোভের ছাপ।


অনিমেষ দ্রুত সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার পায়ের নিচের মেঝেটি হঠাৎই যেন ভারী হয়ে গেল। সে অনুভব করল যেন মর্গের পুরো জায়গাটি তাকে গিলে ফেলতে চাইছে। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, আর কণ্ঠ থেকে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। প্রতিটি মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল এই অন্ধকারের ভেতর সে হারিয়ে যাবে।


তারপরে কিছু অদ্ভুত আওয়াজ শোনা গেল। মর্গের প্রতিটি দেয়াল থেকে এক ধরনের চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। সেই গুঞ্জনে একটা শীতল এবং ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর ছিল, যা অনিমেষের মনকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে দিচ্ছিল। সেই কণ্ঠস্বর বার বার বলছে, “তুমি পালাতে পারবে না…”


এরপর অনিমেষের মন পুরোপুরি ভীত হয়ে যায়। মর্গের দেয়ালে ছায়ামূর্তি ভেসে উঠতে থাকে, আর সেই ছায়াগুলি যেন অনিমেষের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে হঠাৎ করেই খেয়াল করল মর্গের মেঝেতে থাকা সমস্ত লাশই এখন একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে কোনো চাহনি নেই, তবু তাদের দৃষ্টি যেন অনিমেষকে গ্রাস করে ফেলছে।

এভাবে কাটল কয়েক ঘণ্টা, সময় যেন থেমে গেছে, আর অনিমেষের মনে হচ্ছে সে এখানে আটকে গেছে। অবশেষে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলে সেই ভয়াবহ কণ্ঠস্বর এবং ছায়ামূর্তিগুলো মিলিয়ে যেতে লাগল। মর্গের ভেতরের অন্ধকার আস্তে আস্তে আলোতে পরিণত হলো।


সকালে তাকে নিস্তব্ধ ও ভীত অবস্থায় হাসপাতালে খুঁজে পাওয়া যায়। সে কাউকে কিছুই বলতে পারে না, কারণ তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। তার চোখে সেই ভয়ের ছাপ সবসময়ই থেকে যায়, এবং সে আর কোনোদিন মর্গে কাজ করতে যায়নি।

এই গল্পটি মর্গের রাতের নিস্তব্ধতার সেই শূন্যতা এবং আতঙ্ককে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যা পাঠকের মনকে গভীরভাবে গ্রাস করে। এই অভিজ্ঞতা থেকে অনিমেষ কখনোই মুক্তি পায় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ