অ্যাম্বুলেন্সের অন্তিম যাত্রা

 

অ্যাম্বুলেন্সের অন্তিম যাত্রা

মধ্যরাতের গভীর নীরবতা। রাস্তাঘাট ফাঁকা, চারপাশে কেবল নীরবতার এক গভীরতা। শহরের এক হাসপাতালে ডাক্তার রফিক তার রাতের শিফটে রয়েছেন। প্রায়ই রাতের শিফটে কাজ করতে করতে তার ক্লান্তি চলে আসে, তবে এই রাতে কিছু ভিন্ন একটা অনুভব করতে থাকেন তিনি—এক অজানা অস্বস্তি যেন তাকে ঘিরে ধরে আছে।

ঠিক তখনই জরুরি সংকেত আসে—একটা অ্যাম্বুলেন্সে এক মুমূর্ষু রোগীকে দ্রুত অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে। রোগীর অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন, আর তার সাথেই একজন ডাক্তার থাকা প্রয়োজন। রফিক অ্যাম্বুলেন্সের ডাক পেয়ে দ্রুত প্রস্তুতি নেন। রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল করার জন্য যা যা প্রয়োজন তা সব সঙ্গে নিয়ে তিনি অ্যাম্বুলেন্সে ওঠেন।

অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে রোগীকে স্থাপন করা হলো। রোগীটি ছিলেন প্রায় ৭০ বছরের বৃদ্ধ। তার মুখমণ্ডল ফ্যাকাসে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তার চোখ খোলা, তবে যেন কোথাও দূরে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে ছিল এক গভীর শূন্যতা, যেন তিনি কোনো এক অজানা ভয়ের মধ্যে ডুবে আছেন। রফিক তার নাড়ির গতি পর্যবেক্ষণ করতে করতে লক্ষ করলেন, রোগীর শরীর অত্যন্ত ঠাণ্ডা। কেমন একটা অজানা আশঙ্কা বয়ে গেলো তার মনে।

অ্যাম্বুলেন্সটি মধ্যরাতের অন্ধকার পথ ধরে ছুটছে। চারপাশে কোনো আলো নেই, কেবল রাস্তার দু’পাশে ছায়ার মতো গাছপালা। রাস্তার বাতিগুলো দূরে দূরে, মাঝেমাঝে হালকা ঝাপসা আলো যেন ম্লান হয়ে আসছে। গাড়ির ভিতরে ভৌতিক এক নীরবতা, কেবল মাঝে মাঝে রোগীর অস্বাভাবিক কাশির শব্দ ভেসে আসে।

গাড়ি চলছে, আর সেই রাত যেন ক্রমে আরো গভীর হয়ে উঠছে। হঠাৎ করেই রফিক একটা শীতল হাওয়া অনুভব করলেন। অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরের পরিবেশ একেবারে জমাট হয়ে উঠেছে, যেন শীতের এক মর্মান্তিক স্পর্শ তাদের চারপাশে ঘিরে আছে। তিনি রোগীর দিকে তাকালেন, রোগীর মুখের অভিব্যক্তি ভয়ানক রকমের স্থির এবং তার দৃষ্টিতে ছিল এক অভিশপ্ত শূন্যতা।

হঠাৎ করেই, রফিক লক্ষ্য করলেন অ্যাম্বুলেন্সের এক কোণে ছায়ার মতো কিছু একটা চলতে দেখা যাচ্ছে। প্রথমে তিনি ভাবলেন হয়তো তার চোখের ভুল, ক্লান্তির কারণে এমন হচ্ছে। কিন্তু সেই ছায়ামূর্তি যেন আরও পরিষ্কার হতে থাকে। একটি অস্পষ্ট মানব আকৃতির ছায়া যেন ধীরে ধীরে অ্যাম্বুলেন্সের এক কোণ থেকে অন্য কোণে সরে যাচ্ছে। সেই ছায়ামূর্তির কোনো মুখ নেই, তার অস্তিত্ব যেন এক অদৃশ্য দুঃস্বপ্নের মতো যা কেবল অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায়।

রফিক কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে রোগীর দিকে মনোযোগ দেন। ঠিক তখনই তিনি দেখতে পান, রোগীর ঠোঁট থেকে রক্তের একটি ছোট ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ করেই রোগীর হাত তার নিজের মতো করে নড়ে উঠল। রফিক বুঝতে পারলেন না, কিন্তু তার শরীরে হিমশীতল এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। রোগীর ঠাণ্ডা হাতটা যেন তার দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে, আর সেই দৃষ্টিতে ছিল এক ধ্বংসাত্মক ইঙ্গিত।

রফিক তার চিকিৎসা সরঞ্জাম ঠিক করতে করতে এক অজানা চাপ অনুভব করলেন। অ্যাম্বুলেন্সের চারপাশ যেন ঘন কালো ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে। তার মনে হলো যেন অ্যাম্বুলেন্সটি অন্য কোনো পৃথিবীতে চলে যাচ্ছে। এসময় অ্যাম্বুলেন্সের চালকও কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলেন। চালক আয়নায় তাকিয়ে দেখলেন রফিকের পাশেই এক অদ্ভুত ছায়া।

হঠাৎ করেই রোগীর চোখ পুরো খোলা হয়ে গেল এবং সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রোগীর সেই তাকানোতে ছিল কোনো মানবিকতার ছাপ নয়, বরং এক অভিশপ্ত ভৌতিক দৃষ্টি। রফিক বুঝতে পারলেন না কেন, কিন্তু তার মনে হলো রোগীটি তার ভেতরের অন্ধকারকে গভীরভাবে দেখতে পাচ্ছে। যেন সেই চোখ দুটি তার প্রাণের সমস্ত ভয়কে ছুঁয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে সব আলো নিভে গেল। এক অন্ধকার যেন পুরো গাড়ির মধ্যে ছেয়ে গেল। রফিকের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, তার চারপাশে এক চাপা গুঞ্জন শুরু হল। মনে হল চারপাশের দেয়াল থেকে এক ধরনের ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে। সেই ফিসফিসানির কণ্ঠস্বর ছিল যেন অশরীরী, যা তাকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

রফিক আতঙ্কে জমে গিয়েছিলেন। হঠাৎ করেই তিনি অনুভব করলেন, সেই ছায়া তাকে আরও কাছে চলে আসছে। তার গায়ে ঠাণ্ডা একটা স্পর্শ অনুভব করলেন, যা শরীরের সমস্ত শক্তি যেন শুষে নিচ্ছে। রোগীটি এবার উঠে বসে পড়ল এবং তার চোখে ছিল এক প্রবল জ্বালা ও শূন্যতার দৃষ্টি।

রফিক তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থামাতে বললেন চালককে। চালক গাড়ি থামাতে পারল না, কারণ অ্যাম্বুলেন্সের ব্রেক ঠিকমতো কাজ করছে না। চারপাশের রাস্তা ঘন কালো ছায়ায় ঢেকে গেছে। তখন হঠাৎ করে তারা দেখতে পেল গাড়ির সামনের কাচে সেই একই ছায়ামূর্তি ভেসে উঠেছে।

রফিক বুঝতে পারলেন এই অ্যাম্বুলেন্স থেকে তিনি বের হতে পারবেন না। তিনি মনে মনে প্রার্থনা শুরু করলেন, আর অনুভব করলেন তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তার চারপাশের সবকিছু কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে গেল, চারপাশের অন্ধকার যেন তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে।

এভাবে রাত কেটে যায়। পরের দিন সকালে, অ্যাম্বুলেন্সটি একটি নির্জন রাস্তার ধারে থেমে ছিল। স্থানীয় লোকজন এসে দেখতে পায়, ভেতরে একজন ডাক্তার নিথর হয়ে বসে আছেন, তার চোখ খোলা এবং তার দৃষ্টিতে ভয় আর হতাশার ছাপ। অ্যাম্বুলেন্সের চালকও সেদিন থেকে আর কিছুই মনে করতে পারে না। এই ঘটনার পর থেকে কেউ আর সেই রোগীর সম্পর্কে কিছু শোনেনি, আর রফিকও আর কোনোদিন অ্যাম্বুলেন্সে কাজ করার সাহস পাননি।

সেই অভিশপ্ত রাতটি তার জীবনে এক অমোচনীয় দাগ ফেলে যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ