কালো জাদুর মায়াজাল

 

কালো জাদুর মায়াজাল

গ্রামটির নাম ছিল নবগ্রাম। এটি ছিল এক নিরিবিলি, শান্ত গ্রাম, যেখানে দিনের বেলা সবার মধ্যে হাসি, আনন্দ, আর কাজের ব্যস্ততা দেখা যেত। তবে রাতের বেলায় গ্রামটিকে ঘিরে এক রহস্যময় অন্ধকার ছেয়ে যেত। বিশেষ করে গ্রামের পশ্চিম কোণায় অবস্থিত এক পুরনো বাড়ি নিয়ে ছিল নানা ভয়াবহ গল্প। সেই বাড়িতে বাস করতেন এক প্রাচীন সাধক, নাম তার শম্ভুনাথ। শম্ভুনাথের বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি, কিন্তু দেখতে মনে হতো আরও বয়স্ক।

গ্রামের কেউ জানত না, তবে গোপনে গোপনে শম্ভুনাথ ছিলেন কালো জাদুর এক মন্ত্র সাধক। তিনি রাতের গভীর অন্ধকারে তার বাড়ির মধ্যে নানা ধরনের মন্ত্র উচ্চারণ করতেন, যা গভীর রাতের নীরবতাকে ভেদ করে বাতাসে মিশে যেত। তার বাড়ির আশেপাশে রাতে কেবল তারাই যেতে সাহস করত, যারা আদতে বোঝে না কালো জাদুর ভয়াবহতা। সাধারণ মানুষ জানত না, শম্ভুনাথ তার মন্ত্র সাধনার মাধ্যমে নানা অভিশপ্ত আত্মাকে বন্দী করে রেখেছেন, যা তার বাড়ির চারপাশে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায়।

একদিন রাতে, শম্ভুনাথ সিদ্ধান্ত নিলেন এক ভয়ঙ্কর কালো জাদু মন্ত্র সাধনা করার। এ সাধনার মাধ্যমে তিনি আরও বড় শক্তি অর্জন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ ছিল এমন এক শক্তি, যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নিজের উপরই বিপদ ডেকে আনতে পারে। তিনি নিজের ঘরের মধ্যে একটি মন্ত্রের বৃত্ত এঁকে তার ভেতর বসে সাধনা শুরু করলেন। চারপাশে ধূপের ধোঁয়া, বাতাসে এক ধরনের ঝাঁঝালো গন্ধ, আর তার চারপাশে জ্বলতে থাকা মোমবাতির মৃদু আলোতে তার মুখমণ্ডল আরও ভয়ঙ্কর লাগছিল।

রাত গভীর হতে থাকল, আর মন্ত্রের উচ্চারণে তার চারপাশে এক অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি অনুভূত হতে লাগল। হঠাৎ করেই, ঘরের ভেতরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। মোমবাতির আলো কেঁপে কেঁপে উঠল, আর শম্ভুনাথ অনুভব করলেন যেন কেউ তার আশেপাশে আছে। তিনি মনোযোগ বাড়ালেন, মন্ত্রের শক্তিকে আরও গভীরভাবে আহ্বান করতে শুরু করলেন। কিন্তু ঠিক তখনই তিনি অনুভব করলেন কিছু একটা ভুল হচ্ছে। তার চারপাশের বাতাসে শীতল একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল, যেন এক অদৃশ্য ছায়া তাকে ঘিরে রেখেছে।

তাকে ঘিরে ছিল কয়েকটি ছায়ামূর্তি। এগুলো ছিল তারই ডাকা আত্মা, যারা তার কালো জাদুর মায়াজালে আটকে ছিল এতদিন। কিন্তু আজ তার সাধনায় কিছু ভুল হয়ে গেছে। সে অনুভব করল, তার আহ্বানে আটকে রাখা আত্মাগুলো একে একে মুক্তি পেতে শুরু করেছে। সেই মুহূর্তে তিনি বুঝলেন, নিজের সাধনায় এতদিন যে শক্তিকে তিনি বন্দী করে রেখেছিলেন, তা তার নিজের ওপর অভিশাপ হয়ে ফিরে আসছে।

হঠাৎ করেই সেই ছায়ামূর্তিগুলো একত্রিত হয়ে তার চারপাশে ঘন হয়ে উঠল। তাদের চোখের ভেতরে এক গভীর শূন্যতা, যেন মৃত্যু নিজে সেখানে বাস করছে। তারা শম্ভুনাথকে অভিশপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল, যেন তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। শম্ভুনাথের শরীর ভারী হয়ে উঠল, তার নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিল।

তিনি মুক্তি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করতে থাকলেন, কিন্তু সেই আত্মাগুলো তাকে ছেড়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা দেখাল না। শম্ভুনাথ অনুভব করলেন তার শরীরের শক্তি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, তার চোখের সামনে সবকিছু ধীরে ধীরে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। তার নিজের মন্ত্রই যেন তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলেছে।

শম্ভুনাথ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি বুঝতে পারলেন, কালো জাদুর এই পথ আসলে এক অভিশপ্ত যাত্রা যা তাকে আরও গভীর অন্ধকারে নিয়ে চলে যাচ্ছে। তার নিজের কণ্ঠ থেমে গেল, তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল, আর চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই আত্মাদের অভিশপ্ত মুখ। প্রতিটি আত্মা যেন তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তার জীবনশক্তি শুষে নিচ্ছে।

পরের দিন সকালে, গ্রামবাসীরা শম্ভুনাথের ঘরে প্রবেশ করে দেখতে পেল তার নিথর দেহ মাটিতে পড়ে আছে। তার চোখ খোলা, তবে সেই চোখে ছিল গভীর শূন্যতা ও ভয়। তার মুখে ছিল এমন এক অভিব্যক্তি, যেন সে জীবনের শেষ মুহূর্তে এক ভয়াবহ অভিশাপের সম্মুখীন হয়েছিল।

গ্রামের লোকজন সেই ঘটনার পর থেকে শম্ভুনাথের বাড়ির দিকে আর কখনোই তাকায় না। কারণ সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করল, সেই কালো জাদুর অভিশপ্ত শক্তি এখনও সেই বাড়িতে আটকে আছে, এবং মাঝরাতে সেখানে আজও ছায়ামূর্তি ঘুরে বেড়ায়। তারা জানে, সেই কালো জাদুর মায়াজালে আটকে পড়া শম্ভুনাথের আত্মা আজও মুক্তি পায়নি এবং সে আজও সেই বাড়ির অন্ধকারে অপেক্ষা করে, যেন কাউকে নিজের সেই অভিশপ্ত পথে টেনে নিয়ে যেতে পারে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ