শব্দহীন গ্রাম

 

শব্দহীন গ্রাম

কিছুদিনের ছুটি পেয়ে তৌফিক আর তার বন্ধুদের মাথায় হঠাৎই এক সাহসী পরিকল্পনা এল—তারা ছুটে যাবেন পাহাড়ি কোনো নির্জন গ্রামে, যেখানে খুব কম মানুষ যায়। শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই এই পরিকল্পনা। আর এজন্যই তারা বেরিয়ে পড়ল এক পাহাড়ি গ্রামে, যার নামও ঠিকমতো কারো জানা নেই। শুধু শুনেছিল, পাহাড়ি এলাকার কাছেই আছে এমন এক গ্রাম, যেখানে মানুষ খুব কম বাস করে। যাত্রাপথেই তারা ঠিক করল, এবার শুধু প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটাবে, মোবাইল ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া এসব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকবে।


গুগল ম্যাপের ওপর ভরসা করেই তারা রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেল সেই নির্দিষ্ট গ্রামে। এক পাহাড়ি পথ ধরে গ্রামে ঢুকতেই তৌফিকদের মনে হলো যেন তারা অন্য এক জগতে প্রবেশ করেছে। গ্রামের চারপাশে বড় বড় সবুজ গাছপালা, আর এক ধরনের সুনসান নীরবতা। কিন্তু এই নির্জনতা যতটা শান্তির হওয়া উচিত ছিল, ততটাই রহস্যময় ও ভীতিকর মনে হতে লাগল।

গ্রামের মানুষজন যেন তেমন একটা বাইরে আসে না, আর যারা দেখা গেল, তারা সবাই খুবই গম্ভীর। তৌফিকদের দিকে তারা অপলক চেয়ে রইল, কিন্তু মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না। গ্রামে ঢোকার সময়ই তৌফিক আর তার বন্ধুরা লক্ষ্য করল যে, এখানে সবাই চুপচাপ। এমনকি একে অপরের সাথে কোনো কথা বলছে না কেউই।


তৌফিকের বন্ধু রবি বলল, “এই গ্রামে সবাই কি মূক?” তৌফিক একটু আশ্চর্য হয়ে মাথা নাড়ল, “আসলেই তো! কেউ কথা বলছে না। খুব অদ্ভুত না?”


তাদের কথার উত্তর কেউ না দিয়ে শুধু কয়েকজন গ্রামবাসী চোখ তুলে তাকাল, কিন্তু কোনো শব্দ করল না। তৌফিক আর তার বন্ধুরা আশেপাশে ঘুরে দেখতে শুরু করল, আর একের পর এক রহস্যময় বিষয় তাদের সামনে উদ্ঘাটিত হতে লাগল। গ্রামের দোকানগুলোতে কোনো পণ্যের দাম নিয়ে দরকষাকষি নেই, নীরব ইশারায় চলছে সব লেনদেন। আর কেউ কারো সাথে কথা বলছে না, যেন কোনো অলিখিত নিয়মে সবাই বাধ্য।


তৌফিক আর তার বন্ধুরা একটু এগিয়ে যেতেই দেখল, গ্রামের ঠিক মাঝখানে একটি বড় ঝর্ণা আছে, যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় গ্রামের সবাই এসে একত্রিত হয়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, ঝর্ণার সামনে আসা মাত্রই সবাই চুপ হয়ে যায়, যেন কেউ কথা বললেই কোনো বিপদ ঘটবে। গ্রামের একজন প্রবীণ ব্যক্তি এসে তাদের ইশারায় বলল, সন্ধ্যা নামলে ঝর্ণার কাছে চলে আসতে।

তারা ঠিক করল, সন্ধ্যায় গ্রামের এই মেলাটাই ঘুরে দেখবে। সন্ধ্যা নামার পর গ্রামের সবাই চুপচাপ আস্তে আস্তে ঝর্ণার চারপাশে জড়ো হতে শুরু করল। ঝর্ণা থেকে পানির শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। কেউ কথা বলছে না, হাসছে না, কোনো রকম আওয়াজ নেই।


এই দৃশ্য দেখে তৌফিকদের মনে কৌতূহল বাড়ল। তৌফিক একটু ফিসফিস করে তার বন্ধু রাশেদকে বলল, “এত নীরব কেন সবাই? এরা কি কখোনো কথা বলে না?”


রাশেদ একটু ঝুঁকে বলল, “আমাদের প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করা উচিত। হয়তো এখানে শব্দ করলেই নিষেধাজ্ঞা আছে।”


হঠাৎ তারা দেখল, তাদের কথা বলার সাথে সাথে গ্রামের একজন বৃদ্ধ তাদের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন। তিনি চুপচাপ এগিয়ে এসে ইশারা করলেন যেন তারা কথা না বলে চুপ করে থাকে। তৌফিক বুঝতে পারল, এখানে শব্দ করাটা বিপদের কারণ হতে পারে।


রাত বাড়তেই ঝর্ণার চারপাশে অদ্ভুত এক ধোঁয়াশা দেখা দিতে লাগল। সেই ধোঁয়াশার মধ্যে এক রহস্যময় আওয়াজ শুনতে পেল তারা, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের প্রতি বিরক্ত হচ্ছে। সেই আওয়াজ শোনামাত্রই গ্রামের সবাই আরও নীরব হয়ে গেল, কেউই মুখ খুলল না।

তৌফিক আর তার বন্ধুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। তারা বুঝতে পারল, এখানে কোনো অদ্ভুত অভিশাপের প্রভাব আছে। ঝর্ণার পানি থেকে সেই আওয়াজ আসছিল। হঠাৎ করে তাদের মনে হলো, শব্দ করলেই যেন সেই অদৃশ্য শক্তি আরও রাগান্বিত হয়ে উঠছে।


তৌফিকের বন্ধু রবি ভয়ে চিৎকার করে উঠতে গিয়েছিল, কিন্তু তৌফিক তাকে থামিয়ে দিল। গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি এসে ফিসফিস করে বললেন, “এই ঝর্ণার পানি অভিশপ্ত। এখানে কেউ কোনো শব্দ করতে পারে না। কয়েক শতাব্দী আগে এখানে এক ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল, আর সেই থেকেই এই ঝর্ণায় নীরবতার শপথ নেওয়া হয়েছে।”


তৌফিক অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “কী ঘটেছিল এখানে?”


প্রবীণ ব্যক্তি বললেন, “একসময় এখানে এক শক্তিশালী মানুষ বাস করত। তার কাছে অমরত্বের একটি গোপন রহস্য ছিল, আর সেই রহস্যের পাহারাদার ছিল এই ঝর্ণা। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সে এক অভিশাপ রেখে যায়—যদি কেউ এখানে শব্দ করে, তাহলে তার আত্মা সেই ব্যক্তির শরীরের উপর প্রতিশোধ নেবে।”

শুনে তৌফিক আর তার বন্ধুরা আতঙ্কে কাঁপতে লাগল। তারা বুঝতে পারল, কেন সবাই চুপ করে থাকে। গ্রামবাসীরা এই অভিশাপের কথা জানে এবং তাই তাদের জীবন কাটে সম্পূর্ণ নীরবতায়।


তৌফিক আর তার বন্ধুরা সেই রাতটা কষ্টেসৃষ্টে কাটাল, ভয়ে মুখে একটিও শব্দ করল না। পরদিন সকালে তারা গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। শহরে ফিরে আসার পর তারা বুঝতে পারল, তারা এমন এক গ্রাম থেকে ফিরে এসেছে, যেখানে নীরবতাই জীবনের নিরাপত্তার জন্য বাধ্যতামূলক।

এই গল্পটি তাদের জীবনে আজও এক অদ্ভুত স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে। শব্দহীন গ্রামটি যেন তাদের শিখিয়েছিল, কোনো কোনো স্থানে নীরবতাই আসলে সবচেয়ে বড় অস্ত্র।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ