ভূতুড়ে ছবি

 


রনি একজন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার। তার ক্যামেরা, লেন্স, আর শুটিং স্পটের প্রতি ভালোবাসা যেন সীমাহীন। প্রায়ই সে নতুন নতুন জায়গায় যায় আর ছবি তুলে নিয়ে আসে। তার এই কাজের জন্যই একদিন তার কাছে একটা পুরোনো ক্যামেরা আসে। ক্যামেরাটা একটা নামকরা প্রাচীন দোকান থেকে কিনেছিল, যার মালিক জানালেন যে এই ক্যামেরাটা বিশেষ ধরনের, একসময় বিখ্যাত ফটোগ্রাফাররা এই ক্যামেরা ব্যবহার করতেন। রনি আনন্দিত হয়ে সেটি কিনে নিলো এবং নতুন ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল নতুন কিছু ছবি তুলতে।

প্রথমেই সে শহরের এক পুরোনো বাড়িতে গেল। দিনের আলোতে সেই বাড়ি নিয়ে কোনো রহস্য মনে হয়নি, কিন্তু রাতের দিকে বাড়িটা যেন অন্যরকম অনুভূতি দিচ্ছিল। সেই বাড়ির কিছু ছবি তুলতে গিয়ে রনি খেয়াল করল, ক্যামেরার ভিতর থেকেই যেন একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বেরোচ্ছে। সে ভ্রু কুঁচকে এগুলো মনে করল হয়তো ঠাণ্ডা বাতাসের জন্য, কারণ রাত হয়ে আসছিল।


কিছু ছবি তুলে যখন সে বাড়ি ফিরল, তখন ছবি দেখতে শুরু করল। প্রথম দৃষ্টিতে সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হলো। কিন্তু হঠাৎই একটা ছবিতে সে দেখতে পেল, ছবির পেছনের অন্ধকার অংশে একজনের আবছা ছায়া রয়েছে, যেটা সেখানে থাকার কথা নয়। প্রথমে ভাবল এটা তার ভুল হচ্ছে, হয়তো ক্যামেরার অস্বচ্ছ ফিল্টার বা আলোর রিফ্লেকশন।

পরের দিন সকালে সে আবার ক্যামেরা নিয়ে শহরের অন্য জায়গায় ছবি তুলতে গেল। এবার একটা পার্কে গিয়ে কিছু ছবি তুলল। পার্কের ছবি তোলার সময়ও মনে হলো, কেউ যেন তার ওপর নজর রাখছে। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে সে ছবিগুলো তুলল। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ছবিগুলো খুলে দেখতে গিয়ে সে রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গেল। সব ছবিতেই একটা সাদা ছায়াময় অবয়ব পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ছায়াটা কোথাও ঝাপসা, কোথাও স্পষ্ট, কিন্তু এটা স্পষ্ট যে ওই ছায়াটা সেখানে বাস্তবে থাকার কথা নয়।


রনি আরও কিছুদিন ক্যামেরাটা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছবি তুলতে লাগল। প্রতিবারই নতুন নতুন ছবি তুলল, আর প্রতিবারই সেই অবয়বটা হাজির হয় ছবিতে। কখনও সে কোনো রাস্তার পাশে, কখনও কোনো ভবনের ব্যালকনিতে, আবার কখনও রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রনি কিছুতেই বুঝতে পারছিল না এই রহস্যের সমাধান।


একদিন তার বন্ধু তপু, যে ভৌতিক কাহিনী ও রহস্যময় ঘটনার প্রতি খুবই কৌতূহলী, রনির বাসায় এল। তপুকে পুরো ঘটনা খুলে বলল রনি এবং সব ছবি দেখাল। ছবিগুলো দেখেই তপু চমকে উঠল। সে জানাল যে, ছবিগুলোর পেছনের অবয়বটা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, কিছু একটা অশুভ শক্তি বা অতিপ্রাকৃত অস্তিত্বের ইঙ্গিত করছে।

তপু পরামর্শ দিল, “এটা পুরোনো ক্যামেরা, তাই হয়তো এর সঙ্গে কিছু ভৌতিক বা অভিশপ্ত ইতিহাস জড়িত আছে। আমাদের ক্যামেরাটির উৎস জানতে হবে।”


তাদের তদন্ত শুরু হল ক্যামেরাটির ইতিহাস খুঁজতে। সেই দোকানে ফিরে তারা মালিকের সাথে কথা বলল। দোকানদার প্রথমে কিছু বলতে চাইল না, কিন্তু তপু অনেক জোরাজুরি করলে অবশেষে তিনি বললেন, “এই ক্যামেরাটা এক বিখ্যাত ফটোগ্রাফারের ছিল, যার নাম ছিল অমিত। তিনি এক সময় ভূতুড়ে জায়গায় ছবি তুলতেন, এবং সেই কাজ করতে গিয়েই এক ভয়ংকর দুর্ঘটনার শিকার হন। তার মৃত্যুর পর এই ক্যামেরাটা লোকমুখে অভিশপ্ত হয়ে ওঠে।”


রনি এব তপু আরও জানল যে, অমিত একবার এক নির্জন গ্রামে গিয়ে পুরোনো জমিদার বাড়ির ছবি তুলছিলেন। সেখানেই তিনি রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান। কেউ তাকে আর খুঁজে পায়নি, তবে গুজব রটে ছিল যে, তার আত্মা সেই ক্যামেরার ভেতর বন্দী হয়ে আছে।


রনি সব শুনে শিউরে উঠল। সে বুঝতে পারল, প্রতিটি ছবিতে যে অবয়বটা দেখা যাচ্ছে, সেটা হয়তো অমিতের আত্মা। সে হয়তো এখনও মুক্তির অপেক্ষায় আছে।


তপু বলল, “তাহলে এবার আমাদের সেই জমিদার বাড়িতে যেতে হবে, যেখানে এই ক্যামেরার রহস্য শুরু হয়েছিল।”

রনি ভয় পেয়েও সাহস করে সেই জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল তপুর সাথে। বাড়িটা এখন ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। চারদিকে শ্যাওলা জমে আছে, দেয়ালে ফাটল ধরেছে, আর বাতাসে একটা ছমছমে অনুভূতি ছড়িয়ে আছে। তারা বাড়ির ভেতরে ঢুকল, আর প্রতিটি ঘর খুঁজে দেখতে লাগল। হঠাৎই রনি অনুভব করল কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে।


একটা পুরোনো ঘরে এসে রনি ছবি তোলা শুরু করল, আর সেই পুরোনো ক্যামেরায় তাক করতেই হঠাৎই পেছন থেকে একটা ঠাণ্ডা হাত তার কাঁধে পড়ল। রনি চমকে উঠল, পেছনে ফিরে দেখল কেউ নেই। তপুও সেখানে ছিল না। ভয় আর কৌতূহলে সে আবার ক্যামেরার দিকে তাকাল।


এবার ছবি তুলতেই ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ হয়ে এক ঝলক আলো ফুটে উঠল। সে যখন ছবিটা দেখে, সেখানে দেখা গেল স্পষ্ট একটি অবয়ব—অমিত। অমিতের আত্মা যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন তাকে কিছু বলতে চাইছে। রনি অনুভব করল, অমিত তাকে মুক্তি দিতে বলছে।


ঠিক তখনই তপু এসে হাজির হল, এবং রনিকে বলল, “তোর মুখের রং সাদা হয়ে গেছে! কী দেখলি?”


রনি ধীরে ধীরে সব খুলে বলল। তপু তাকে পরামর্শ দিল ক্যামেরাটি সেই জমিদার বাড়ির ভেতরে রেখে আসতে। কারণ অমিতের আত্মা হয়তো এই জায়গায়ই তার শান্তি পাবে।

রনি শেষবারের মতো ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে সেটিকে মাটিতে রেখে দিল। ক্যামেরা থেকে হঠাৎই একটা হালকা আলোর ঝলক দেখা গেল, যেন কিছু একটা বেরিয়ে গিয়ে শূন্যে মিশে গেল। রনি আর তপু দ্রুত স্থানটি ছেড়ে বেরিয়ে এলো। সেই রাতে আর কেউই ঘুমাতে পারল না।


পরের দিন রনি আর কখনো সেই ক্যামেরার কথা ভাবল না, তার সমস্ত আতঙ্ক আর কৌতূহল এক জায়গায় মিশে শান্তি পেল। তবে রনি জানে, প্রতিটি ছবির পেছনে একটা না বলা গল্প থাকে, আর সেই গল্পের কিছুটা হয়তো ক্যামেরার মাঝেই চিরকাল বন্দী থেকে যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ