শূন্যতা থেকে আসা ডাক


 

শূন্যতা থেকে আসা ডাক


রাজীব একেবারে নিঃসঙ্গ জীবনে প্রবাহিত হচ্ছিল। তিনি একজন ব্যবসায়ী, কিন্তু তার কাজের কারণে তার সঙ্গীর অভাব ছিল। একমাত্র বন্ধু অজয় হঠাৎ মারা যাওয়ার পর তার জীবন আরও বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল। অজয়ের মৃত্যুর পর রাজীবের মনে সেই অদ্ভুত কষ্ট রয়ে গিয়েছিল। দিনের পর দিন তিনি তার প্রিয় বন্ধুর কথা মনে করতেন, কিন্তু সেই স্মৃতিগুলো তাকে একাকী করে তুলেছিল।


একদিন সন্ধ্যায়, রাজীব বাড়িতে বসে টেলিভিশন দেখছিলেন। হঠাৎ তার মোবাইলে একটি অদ্ভুত নম্বর থেকে কল এলো। ফোনটি উত্তোলন করার সাথে সাথে অপর প্রান্ত থেকে অজয়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। “রাজীব! আমি অজয়।”


রাজীব হতবাক হয়ে গেল। “এটা কি সম্ভব? তুমি তো মৃত!”


অজয় হাসির সাথে বলল, “হ্যাঁ, আমি জানি। কিন্তু আমি তোমার কাছে আসতে চাচ্ছি। কিছু কথা বলার জন্য।”


“কী বলবে?” রাজীব বলল, তার কণ্ঠে উত্তেজনা ও ভয়ের মিশ্রণ।


“শুধু শোনো,” অজয় বলল। “তোমার জন্য আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রেখে গিয়েছি। যা জানলে তুমি বিস্মিত হবে।”


রাজীব দোটানায় পড়ল। কিন্তু অজয়ের কথা শুনতে সে অবশেষে রাজি হল। সে অজয়ের প্রতি আস্থা হারায়নি, কারণ তাদের বন্ধুত্বের ইতিহাস ছিল গভীর।

“কোথায় তোমার কিছু?” রাজীব জিজ্ঞেস করল।


“তুমি আমাদের পুরনো ক্যাফেতে আসো, সেখানে আমি তোমার জন্য কিছু রেখেছি। মনে রেখো, সময় খুব কম। দ্রুত আসো!” অজয় বলল এবং হঠাৎ করে ফোনটি কেটে গেল।


রাজীব একবার ভাবল, কিন্তু তারপরই পুরনো ক্যাফের স্মৃতি তার মনে ফিরে এলো। সেখানে তারা কতবার আড্ডা দিয়েছিল, সেখানকার পরিবেশ, সেখানকার আড্ডা! রাজীব নিজেকে সংবেদনশীল মনে করছিল। তিনি দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।


ক্যাফে পৌঁছানোর পর, তিনি অজয়ের প্রিয় টেবিলের কাছে গেলেন। টেবিলটি এখনও সেখানে ছিল, কিন্তু অজয় কোথাও ছিল না। রাজীব টেবিলের উপর একটি পুরনো কাগজের টুকরো দেখতে পেল। সেটি অজয়ের লেখা ছিল।


“রাজীব, আমি জানি তুমি এখানে এসেছ। আমার মৃত্যুর পর কিছু গোপনীয়তা প্রকাশ হয়েছে, যা আমার মৃত্যু নিয়ে অনেক প্রশ্ন তৈরি করেছে। আমি চাই তুমি এগুলো খুঁজে বের কর। কিছু পুরনো ছবি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তুমি সেই ছবিগুলি সংগ্রহ করলেই সবকিছু পরিষ্কার হবে।”


রাজীবের মনে ধকল লাগল। “কী ছবির কথা বলছ?”


তিনি কাগজটি ভালোভাবে দেখলেন এবং অজয়ের হাতের লেখা চিনতে পারলেন। এটি একটি পুরনো ছবির স্থানের নির্দেশিকা ছিল। ছবির স্থানটি শহরের বাইরে, একটি পুরনো বাড়ির কাছে ছিল।

রাজীবের মধ্যে নতুন করে সাহস জেগে উঠল। তিনি ভাবলেন, “যা হোক, আমাকে সত্যি খুঁজে বের করতে হবে। অজয় এমন কিছু ছেড়ে গেছে, যা জানার জন্য আমি আগ্রহী।”


পরদিন সকালে, রাজীব সেই স্থানটি খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল। বাড়িটি ছিল একটি পুরানো জমিদারির বাড়ি, যা দীর্ঘদিন অব্যবহৃত ছিল। সেখানকার পরিবেশ ছিল বিষণ্ণ ও নিঃসঙ্গ। রাজীব বাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে গেল।


“এখানে আমাকে কিছু খুঁজতে হবে,” তিনি মনে মনে বললেন। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার পর অন্ধকার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। একটু সামনের দিকে এগিয়ে গেলে, তিনি দেখতে পেলেন কিছু পুরনো ছবি দেয়ালে ঝুলছে।


এগুলো কি? রাজীব এগিয়ে গিয়ে ছবিগুলো দেখতে লাগল। ছবিগুলোতে অজয়ের অনেক পুরনো স্মৃতি ছিল। সেখানে তারা দুজনে হাসছিল, বন্ধুত্বের মুহূর্তগুলোর ছবি। কিন্তু কিছু ছবি ছিল অদ্ভুত, যেখানে অজয় অন্যদের সঙ্গে ছিল।

“কী হচ্ছে? এরা কারা?” রাজীব ছবিগুলোর দিকে মনোযোগ দিয়ে ভাবতে লাগল।


এখন রাজীব বুঝতে পারছিল, অজয়ের জীবনটি এতটা স্বাভাবিক ছিল না। তার জীবনে কিছু গোপনীয়তা ছিল, যা জানার পর রাজীব ভয় পেতে শুরু করল।


তিনি আরও গভীরভাবে খুঁজতে লাগলেন। একটি কক্ষে প্রবেশ করে তিনি দেখতে পেলেন একটি পুরনো আলমারি। আলমারির দরজা খুলে গেল এবং ভিতরে অনেক পুরনো কাগজ, চিঠি ও অন্যান্য জিনিস ছিল। তিনি সেগুলো বের করে দেখতে লাগলেন।


একটি চিঠি নজর কাড়ল। সেটিতে লেখা ছিল, “প্রিয় রাজীব, আমি জানি তুমি আমার মৃত্যুতে অবাক হয়েছ। কিন্তু আমি চাই তুমি জানো, আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতাম। সেই তথ্যগুলো তুমি কখনও কল্পনা করনি। আমি জানি, আমার মৃত্যুর পরে তুমি একা হয়ে পড়বে। কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কিছু অপরাধের স্বীকার ছিলাম, যা আমি আর করতে পারছিলাম না।”


রাজীবের মনে প্রশ্ন জেগে উঠল। “অজয় কি অপরাধ করেছিল? কিসের জন্য সে মারা গেল?”


তিনি আরও কাগজপত্র বের করতে লাগলেন এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে লাগলেন। সেই তথ্যগুলো অজয়ের গোপন জীবন নিয়ে কথা বলছিল। সেখানে লেখা ছিল অজয় গোপনে কিছু ব্যবসা চালাচ্ছিল এবং একটি বৃহৎ সমস্যার মধ্যে ছিল।

“তিনি কি আমার সাথে মিথ্যা বলেছিলেন?” রাজীব ভেবেছিলেন। “তার মৃত্যুর পেছনে কি এমন কিছু ছিল?”


এখন রাজীবের মনে ভয় কাজ করছিল। তিনি ভাবলেন, অজয়ের মৃত্যুর কারণ নিয়ে তদন্ত করা উচিত। তিনি বিভিন্ন ধরনের তথ্য একত্রিত করলেন এবং সেগুলো যাচাই করতে লাগলেন।


একদিন রাজীবের কাছে একটি ফোনকল এল। “রাজীব, তুমি কি অজয়ের সঙ্গে আমার কথা বলতে পার?” অপর প্রান্ত থেকে একটি অপরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেল।


“কে?” রাজীব জিজ্ঞেস করল।


“আমি রিয়া, অজয়ের বান্ধবী। আমি জানি তুমি তার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করছ।”


রাজীব হতবাক হয়ে গেল। “তুমি কি জানো কিছু?”


“হ্যাঁ, আমি কিছু বলব, কিন্তু তোমাকে সতর্ক থাকতে হবে। অনেক কিছু ঘটে গেছে, যা তুমি কল্পনা করছো না। অজয় কিছু গোপন তথ্য জানত, যা তাকে মারাত্মক বিপদে ফেলেছিল। আমি জানি, তাকে হত্যা করা হয়েছে।”


রাজীবের মনে নতুন করে শঙ্কা বাড়তে লাগল। “তুমি কি আমাকে আরো জানাতে পারবে?”


রিয়া বলল, “আমি তোমাকে আগামীকাল একটি স্থানে আসার জন্য বলব। সেখানেই আমি সব খুলে বলব। তবে সাবধান হও।”


রাজীব পরের দিন রিয়া’র সাথে দেখা করতে গেল। সেখানে রিয়া জানাল, অজয় কিছু গোপন কাজের সাথে জড়িত ছিল, যা তাকে বিপদের মধ্যে ফেলেছিল।


“তার মৃত্যুর পেছনে কিছু দুষ্ট ব্যক্তির হাত ছিল। তুমি যদি সত্যটি বের করতে চাও, তবে সাবধান হও,” রিয়া সতর্ক করল।

রাজীব বুঝতে পারল, বিষয়টি অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়েছে। তিনি সমস্ত তথ্য নিয়ে একটি পরিকল্পনা তৈরি করলেন। তিনি অজয়ের মৃত্যুর তদন্ত শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলেন।


দিনের পর দিন, রাজীব বিভিন্ন সূত্র অনুসন্ধান করতে লাগল। তিনি অজয়ের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, এবং পরিচিতদের সাথে কথা বললেন। অবশেষে তিনি একটি অপরাধী গোষ্ঠীর সম্পর্কে তথ্য পেয়েছিলেন, যারা অজয়ের মৃত্যুর পেছনে ছিল।


রাজীব তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে গেল। পুলিশ রাজীবের তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করল। তারা সেই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করল।


বহুদিনের চেষ্টা এবং অধ্যবসনের পর, রাজীব অবশেষে অজয়ের মৃত্যুর কারণ প্রকাশ করল। অজয়ের মৃত্যু একটি দুর্ঘটনা ছিল না, বরং একটি হত্যা। রাজীবের আত্মবিশ্বাস এবং সাহস তার বন্ধুর মৃত্যুর সত্যতা উদঘাটন করতে সহায়ক হয়েছিল।

অজয়ের মৃত্যুর পর রাজীবের জীবনে নতুন উন্মেষ ঘটেছে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জীবন কখনও থামে না, বরং এটি চলতে থাকে। তিনি তার বন্ধুর প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন, অজয়ের স্মৃতিকে কখনও ভুলবেন না এবং প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্যবান করে তুলবেন।


অতঃপর, রাজীবের জীবনে নতুন সূচনা হলো। তিনি নিজেকে একজন মানবিক কর্মী হিসেবে গড়ে তুললেন এবং সমাজের জন্য কাজ করতে লাগলেন। তিনি মানুষের জন্য সহায়তা করতে শুরু করলেন, যাতে অন্য কেউ অজয়ের মতো নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন না হয়।

অজয়ের স্মৃতি রাজীবকে সব সময় প্রেরণা জুগিয়েছিল। তার মৃত্যুর পর তিনি শিখেছিলেন, জীবনে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হলো বন্ধুত্ব, প্রেম এবং একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা। রাজীব অজয়ের নামে একটি দাতব্য সংস্থা গঠন করলেন, যা গরীব ও অভাবী মানুষের সাহায্যে কাজ করবে।


এভাবে রাজীবের জীবনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হলো। মৃত্যুর পর অজয় তার জীবনে যেমন একবার ফিরে এসেছিল, ঠিক তেমনি তার স্মৃতি আজীবন রাজীবকে পথ দেখাবে। রাজীব জানতো, অজয় আর তার পাশে নেই, তবে তার ছায়া সব সময় তাকে অনুপ্রাণিত করবে। এবং এভাবেই রাজীব শূন্যতা থেকে আসা ডাকের মাধ্যমে নিজের জীবনকে নতুন করে গড়ে তুলল, যেখানে বন্ধুত্ব, সাহস এবং মানবিকতার উদাহরণ হয়ে থাকবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ