হাসপাতালের অন্ধকার করিডোর

 

হাসপাতালের অন্ধকার করিডোর

শহরের এক প্রান্তে পুরনো একটি হাসপাতাল। এই হাসপাতালটি একসময় ব্যস্ত ছিল, প্রচুর রোগী আর কর্মচারীর আনাগোনা ছিল সেখানে। তবে কিছু অদ্ভুত ঘটনার কারণে মানুষ সেই হাসপাতাল থেকে দূরে থাকতে শুরু করে। দিন যত গড়ায়, এই হাসপাতালটি যেন আরো বেশি ভৌতিক এবং রহস্যময় হয়ে ওঠে। রাত বাড়লে কেউ সেখানে থাকার সাহস পায় না। এক অজানা ভয়ের ছায়া যেন পুরো হাসপাতালটিকে ঢেকে রাখে।

রাত ১১টা বাজে। হাসপাতালের মূল ফটক বন্ধ, চারপাশে নিস্তব্ধতা। প্রতিটি করিডোর যেন ভয় আর আতঙ্কের রাজ্য। এখানে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এলে নানান অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়। দোতলার ওয়ার্ডে থাকে কিছু পুরনো রোগী, যারা রাতে বিভিন্ন অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। কেউ গভীর রাতে কাঁদতে থাকে, কেউ ছাদে উঠে অজানা ভাষায় কথা বলে। হাসপাতালের কর্মচারীরা এইসব ঘটনা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও, কেউই একা সেই করিডোরে যেতে সাহস পায় না।

এই হাসপাতালের সবচেয়ে ভয়ের জায়গাটি হলো ‘ওয়ার্ড ১৩’। পুরনো কর্মচারীরা বলে, অনেক বছর আগে ওয়ার্ড ১৩-তে এক যুবক রোগী আত্মহত্যা করেছিল। সেই ঘটনার পর থেকে কেউই সেখানে বেশি সময় কাটাতে চায় না। আলো ঠিকভাবে জ্বলে না, মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই নিভে যায়। বাতাসেও এক ধরনের শীতলতা অনুভূত হয়, যা গা শিউরে তোলে।


রাত বাড়ার সাথে সাথে হাসপাতালের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। মনে হয় যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি হাসপাতালের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো রোগী বা কর্মচারী অভিযোগ করে, তারা অদ্ভুত ছায়া দেখেছে। কেউ বলে এক অজানা হাত তার কাঁধে স্পর্শ করেছে, আবার কেউ বলে, করিডোরের শেষে কেউ যেন দাঁড়িয়ে ছিল। একবার এক নার্স গভীর রাতে ওয়ার্ড ১৩-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ দেখল, ঘরের ভেতর আলো জ্বলছে আর সাথে সাথে একটা তীব্র শীতল হাওয়া তার শরীর ছুঁয়ে গেল। নার্স কাঁপতে কাঁপতে ওখান থেকে সরে গেল।

পরের দিন সকালেই নার্সের মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করা যায়। সে শুধু চুপ করে বসে থাকে, মুখ থেকে কোনো কথা বের হয় না। কেউ জিজ্ঞেস করলে শুধু তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে। এরপর তার শরীর দিন দিন আরও দুর্বল হতে থাকে, কিন্তু কী ঘটেছে সে কিছুই বলতে পারে না। হাসপাতালের অন্যান্য কর্মচারীরা এই ঘটনা দেখে আতঙ্কিত হয়।


কয়েকদিন পরে, এক নবীন ডাক্তারও রাতের শিফটে হাসপাতালে ডিউটি করছিল। সে আগে এসব ঘটনা বিশ্বাস করত না। তবে তার ডিউটির প্রথম রাতেই অদ্ভুত কিছু ঘটতে থাকে। রাত প্রায় ২টা বাজে, যখন সে করিডোরে পায়চারি করছিল, হঠাৎ করেই ওয়ার্ড ১৩-এর আলো নিভে গেল। সে এগিয়ে গিয়ে আলোটি জ্বালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু আলো আর জ্বলে না। তখনই তার পেছনে কারো নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল। সে পেছনে ফিরে তাকাল, কিন্তু কেউ নেই। তবু একটা অজানা আতঙ্ক তার মনে ছড়িয়ে পড়ল।

ডাক্তার ভাবল, হয়তো ক্লান্তি বা মানসিক চাপের কারণে এসব ভাবছে। কিন্তু সে করিডোর দিয়ে কিছুটা এগোনোর পর দেখতে পেল করিডোরের শেষ প্রান্তে একজন মহিলার ছায়া। মহিলাটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ডাক্তার স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, তার শরীর যেন পুরো জমে যায়। মহিলার মুখ ছিল একদম ফ্যাকাসে, চোখের তারা নেই, শুধু এক গভীর শূন্যতা। সে যেন ডাক্তারকে কোনো ইঙ্গিত দিয়ে ডাকছে।


ডাক্তার অনেক সাহস করে মহিলার দিকে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে তার মনে হয় যেন শরীরটা আরো ভারি হয়ে যাচ্ছে। তার গলা শুকিয়ে আসে, চোখে ধোঁয়াটে দেখতে লাগে। মহিলাটি অদৃশ্য হয়ে যায়, আর ডাক্তার একটা শীতল বাতাস অনুভব করে। কিছুক্ষণ পর তার চোখ আবার খুললে সে নিজেকে করিডোরের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে।

পরদিন সকালেই তাকে এই অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, কিন্তু তার মন থেকে সেই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা কিছুতেই মুছে যায় না। সে হাসপাতালের কাজ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ তার বিশ্বাস এই হাসপাতালের ভেতরে কিছু আছে, যা রাত্রিকালীন কর্মীদের শিকারে পরিণত করে।

এরপরও হাসপাতালের কাহিনী থেমে থাকেনি। প্রতিটি রাত যেন ভয়াবহ স্মৃতি আর আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি। হাসপাতালের করিডোরগুলোতে লুকিয়ে আছে এক অজানা রহস্য, যা কেউই পুরোপুরি জানতে পারে না। বিভিন্ন রোগী আর কর্মচারীর মনেও প্রশ্ন জাগে—এ হাসপাতাল কি কেবল মানুষের সেবা করতে, নাকি এখানে কেউ অথবা কিছু তাদের ছায়ার মতো ঘিরে রেখেছে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ