দূর পাহাড়ের কোণে এক অদ্ভুত শান্ত গ্রাম। গ্রামটি যেন বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত এই গ্রাম, আর তার মধ্যে অনেক পুরোনো বাড়িগুলোর একটি ছিল একটি বিশাল দোতলা বাড়ি। বাড়িটি অদ্ভুতভাবে নির্জন আর রহস্যময়। শহরের লোকেরা তাকে “রক্তিম বাড়ি” বলেই চিনে। এ বাড়ির পুরনো ঐতিহাসিক শোনা যায়, কিন্তু কেউ কখনো তার ভিতরের ইতিহাস জানতে চায়নি। লোকের মধ্যে গুজব ছিল, যে এই বাড়ির মধ্যে যেসব পরিবার এসেছে, তারা যেন অদ্ভুত দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে। কিছু সময় পর পর নতুন বাসিন্দারা এসে কিছুদিন থাকার পর নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।
এইবার নতুন করে সেই বাড়িতে আসলো মিতুলের পরিবার। শহরের ব্যস্ততা আর দাম বাড়া জীবন থেকে একটু মুক্তি পেতে মিতুল তার স্ত্রী সুমি আর মেয়ে নীলা নিয়ে এই নির্জন গ্রামে চলে এলেন। এ বাড়ির ভিতরের আকার আকৃতি ও পরিপার্শ্ব সত্যিই চমৎকার, এবং তাদের মনে হলো এটা যেন তাদেরই জন্য অপেক্ষা করছিল। তবে গ্রামের কিছু প্রবীণ মানুষ তাদের সতর্ক করল, কিন্তু তারা গুজবকে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের মতোই বাসা গোছাতে শুরু করল।
প্রথম কয়েকদিন বেশ ভালোই কাটল। বাড়িটা দেখতে বেশ আরামদায়ক। চারপাশে গাছপালা, পাখির ডাক, আর সবুজ প্রকৃতি। কিন্তু রাত নামতেই যেন চারপাশের পরিবেশ বদলে যায়। ঘরের ভেতর একটা অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়া বইতে থাকে, যেটা দিনের বেলায় কখনো টের পাওয়া যায় না। প্রথম দু-একদিন মিতুল ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু ঘটনা তখন সত্যিই ভয়ংকর মোড় নেয় যখন রাতের দিকে মেয়ে নীলা কান্নাকাটি শুরু করে। সে বলে, তার ঘরে একজন “লাল পোশাক পরা মহিলা” প্রতিদিন রাতেই এসে দাঁড়ায়।
প্রথমে মিতুল আর সুমি নীলার কথা গুজব ভেবে হাসাহাসি করল। কিন্তু পরের দিন রাতে সুমিও দেখল, বাড়ির রান্নাঘরের পাশের অংশ থেকে একটা লাল আলোর বিচ্ছুরণ হচ্ছে। অন্ধকারে সেই লাল আলো অস্বাভাবিকভাবে জ্বলজ্বল করছিল। সুমি ভয় পেয়ে মিতুলকে ডেকে তুলল, কিন্তু মিতুল সেই লাল আলোর কিছুই দেখতে পেল না।
এভাবে প্রতিদিনই রাতের বেলা কিছু না কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায়, কখনো কখনো বাড়ির ঘড়িগুলো হঠাৎ করে থেমে যায়, আবার মাঝে মাঝে দেয়ালে রক্তের দাগ দেখতে পাওয়া যায়। সুমির মনে ভয় জন্মাতে থাকে, সে নিজেই দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় যে এই বাড়ি কি সত্যিই অভিশপ্ত?
একদিন, রাতে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ মিতুল কিছু শব্দ শুনতে পেল। ঘুম থেকে উঠে সে দেখতে পেল, বাড়ির হলওয়ের এক কোণে লাল আলো জ্বলছে। সাহস করে সে লাল আলোর উৎসের দিকে এগিয়ে যায়। দেখতে পায়, একটি দরজা লুকানো আছে, যেটা সে আগে কখনো খেয়াল করেনি। দরজাটা কিছুটা খোলা, আর তার ভিতর দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া বেরিয়ে আসছে।
মিতুল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর দরজাটা একটু চাপ দিল, আর ভেতরে ঢুকে পড়ল। সে দেখে, ভেতরে অদ্ভুত কিছু চিহ্ন দেয়ালে আঁকা। প্রতিটা চিহ্ন যেন কোন এক ধরণের পুরোনো যন্ত্রণাদায়ক গল্প বলে। দেয়ালে রক্তের মতো লাল রং দিয়ে মানুষদের মুখের ভীতিকর চিত্র আঁকা রয়েছে।
এতক্ষণে তার বুক ধুকধুক করতে লাগল। হঠাৎ পেছন থেকে একটা হাত তার কাঁধে পড়ল। সে চমকে উঠল, ফিরে তাকিয়ে দেখল—তার মেয়ে নীলা দাঁড়িয়ে। তার চোখ যেন অন্যরকম, ঠান্ডা আর নির্জীব। মিতুল ভয়ে কাঁপতে লাগল। সে মেয়ের হাত ধরে বলল, “নীলা, তুমি এখানে কেন? তোমাকে ঘুমাতে বলা হয়েছে তো।”
নীলা কোনো কথা বলল না। বরং তার মুখে একরকম ম্লান হাসি ফুটল। সে ধীরে ধীরে মিতুলকে বলল, “বাবা, তুমি জানো না? এই বাড়ির নিচে এখনও অনেক গল্প লুকিয়ে আছে। এখানে যারা আসে, তারা আর ফিরে যেতে পারে না।”
মিতুলের শরীর হিম হয়ে গেল। তার মেয়ে এমন কথা কেন বলছে? তার মনে হলো, মেয়েটা যেন অন্য কেউ হয়ে গেছে। তার মেয়ে নীলা কখনোই এমন কথা বলতে পারে না। ভয়ে আর ধোঁকায় সে দরজাটা বন্ধ করতে চাইল, কিন্তু তখনই দরজার ফাঁক দিয়ে একটা মৃদু ফিসফিস শব্দ শোনা গেল, যেন তাকে কেউ ডাকছে। শব্দটা যেন বাড়ির নিচের তলা থেকে আসছে।
মিতুল দরজা থেকে পিছু হঠল এবং দ্রুত দৌড়ে এসে সুমিকে ডেকে তুলল। সুমি সব শুনে ভয় পেয়ে গেল, কিন্তু মিতুলকে বুঝাল যে হয়তো এটা তাদের মনের ভুল হচ্ছে। তবুও মিতুল পরদিন সকালেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
পরদিন ভোরবেলা ঘর ছেড়ে যাবার জন্য সব প্রস্তুতি শেষ। কিন্তু যখন তারা প্রায় বের হওয়ার জন্য তৈরি, তখন হঠাৎ দরজার সামনে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ মহিলাকে দেখতে পেল। তিনি গ্রামের একজন প্রবীণ নারী, যিনি এই বাড়ি সম্পর্কে অনেকটা জানেন। তিনি বললেন, “তোমরা চলে যাওয়ার চেষ্টা করছ, কিন্তু যে এই বাড়িতে একবার ঢুকে যায়, সে আর চাইলেই এখান থেকে বের হতে পারে না।”
মহিলার কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল মিতুল। তিনি বললেন, “এ বাড়ির মাটির নিচে অনেক মৃত আত্মা চাপা পড়ে আছে, যারা এখনও মুক্তি পায়নি। তারা প্রতিটি নতুন বাসিন্দাকে ধরে রাখতে চায়। আজ পর্যন্ত কেউই এখানে এসে বেঁচে ফিরতে পারেনি। তোমরা চাইলেও বের হতে পারবে না।”
মিতুল আর সুমি হতবাক হয়ে শুনল। তাদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। তাদের বুঝতে বাকি রইল না যে, এ বাড়ি শুধু একটা বাড়ি নয়, এ এক অভিশপ্ত জায়গা, যেখানে অতীতের ছায়ারা এখনও ঘুরে বেড়ায়।
রক্তিম বাড়ির রহস্য আজও অজানা। গ্রামের মানুষ জানে, যারা এই বাড়িতে আসে, তারা আর ফিরে যেতে পারে না। সেই বাড়ির নিচে চাপা পড়ে থাকে তাদের কান্না আর তাদের গল্প, যেটা কেউ কখনো শোনে না, আর শোনার সুযোগও পায় না।
0 মন্তব্যসমূহ