অচেনা আত্মা |
রাত প্রায় গভীর, আবির হঠাৎই ঘুম ভেঙে উঠল। বুকটা তার ধুকপুক করছে, শীতল ঘামে পুরো শরীর ভিজে গেছে। কয়েকদিন ধরেই সে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে আসছে—এক অচেনা মেয়ের ছায়ামূর্তি যেন তাকে ফলো করছে। মেয়েটি দূর থেকে তাকিয়ে থাকে, তার চোখে যেন আবিরের প্রতি কোনো গভীর ক্ষোভ। প্রথম দিকে আবির এসব উপেক্ষা করেছিল। কিন্তু দুঃস্বপ্ন ক্রমে তার ঘুম কেড়ে নিতে শুরু করল।
আবিরের জীবনটা সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় বদলে গেছে। একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় সে অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিল, যদিও সেদিন তাকে যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল, তা ছিল ভয়ংকর। গাড়িটি পাহাড়ি রাস্তা ধরে ছুটছিল, আর তার চাকার ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল সে। গাড়িটি প্রায় খাদের কিনারায় পৌঁছে গিয়ে থেমে গিয়েছিল। তখন থেকেই সে অনুভব করতে লাগল, যেন কেউ তার চারপাশে আছে। এই ঘটনার পর থেকেই আবিরের জীবনে কেমন যেন একটা অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। তার মনে হতে লাগল, কেউ যেন সারাক্ষণ তাকে অনুসরণ করছে, কেউ হয়তো তার জীবনটা ধ্বংস করতে চায়। প্রথমে সে ভেবেছিল, এটা তার মানসিক দুর্বলতা। কিন্তু দিন দিন এই অনুভূতি তাকে আরো বেশি তাড়া করতে লাগল। একদিন রাতের বেলা আবির অনুভব করল, তার ঘরের কোণায় একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। সে প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো তার চোখের ভুল। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সে বুঝতে পারল, এটা তার মানসিক দুর্বলতা নয়—সত্যিই কেউ বা কিছু তার পাশে আছে। মেয়েটির মুখের রেখা স্পষ্ট হলো, তার ফাঁকা চোখ যেন আবিরের দিকে ফোকাস করছে। আবির তখন নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের রুমে চলে গেল। সেখানে গিয়ে সে জানালার বাইরে তাকাল। বাইরে রাতের অন্ধকার, আকাশে পূর্ণিমার আলো ঠিকরে পড়েছে। সে হঠাৎই অনুভব করল, জানালার বাইরে কোনো একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করেই মেয়েটির ঠান্ডা কণ্ঠ শুনতে পেল, “তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে।” আবিরের শরীরের রক্ত জমে গেল। কণ্ঠটা তার মাথার ভেতর গেঁথে বসে গেল। সে ভাবল, হয়তো এটা কেবল তার মনের ভ্রম, কিন্তু কণ্ঠটা এতটাই বাস্তব যে সে এই অনুভূতি থেকে নিজেকে সরাতে পারছিল না। মেয়েটির কণ্ঠ ভেসে আসছিল আরও গভীরভাবে—একটা অভিশপ্ত কণ্ঠ, যা তাকে একটা দুঃস্বপ্নের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। একদিন আবির তার বন্ধুর কাছে সব খুলে বলল। তার বন্ধু রনি তাকে বলল, “তোর অবস্থা খুবই সিরিয়াস। তোকে এর থেকে বের করে আনার একটা উপায় আমি জানি। এক জায়গায় তোকে নিয়ে যাব, সেখানকার একজন সাধক এর সমাধান দিতে পারবে।” রনি আবিরকে নিয়ে গেল শহরের এক প্রাচীন মন্দিরে। এই মন্দিরের সাধক বিখ্যাত ছিলেন অলৌকিক ঘটনাগুলোর সমাধান দিতে। সাধকের কাছে পৌঁছানোর পর, আবির তাকে পুরো ঘটনা খুলে বলল। সাধক তাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং শেষে বললেন, “তুমি একটি অতি প্রাচীন অভিশাপের শিকার। দুর্ঘটনার সময় তুমি এমন একটি স্থানে ছিলে, যেখানে পূর্বে অনেক অত্যাচারিত আত্মার আত্মা বাঁধা ছিল। তাদের মধ্যে এক আত্মা তোমার সাথে সংযোগ করেছে এবং এখন প্রতিশোধ চায়।” আবির ভয়ে শিহরিত হয়ে বলল, “তাহলে কী করতে হবে?” সাধক বললেন, “এই আত্মা তোমাকে পূর্ণিমার রাতেই সবচেয়ে বেশি ভয় দেখাতে চাইবে। কারণ, সেই রাতেই তার প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এর থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় আছে। তোমাকে সেই প্রাচীন স্থানে ফিরে যেতে হবে এবং আত্মাটির শান্তির জন্য প্রার্থনা করতে হবে। যতক্ষণ না তুমি সত্যিকারভাবে ক্ষমা চেয়ে তার শান্তি কামনা করবে, সে তোমাকে মুক্তি দেবে না।” আবিরের সামনে কোনো উপায় ছিল না। সাধকের কথা মেনে পরের পূর্ণিমার রাতে সে সেই স্থানে ফিরে গেল। জায়গাটা এক নির্জন বনাঞ্চলে ছিল, যেখানে কিছু প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে। রাতের নির্জনতা, চারপাশে অন্ধকার, আর এক ধরনের শীতল বাতাস যেন তাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, যেন প্রতিটি গাছের ছায়া তাকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একটু এগিয়ে গিয়ে আবির মনে মনে বলল, “তুমি যে-ই হও, আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য এসেছ। তোমার কষ্ট যদি আমি বুঝতে পারি, তাহলে শান্তি দাও আমাকে।” হঠাৎ সে অনুভব করল, তার চারপাশে একটা শীতল বাতাস বয়ে গেল, আর সেই কণ্ঠটা আবারও ভেসে এল, “তুমি যদি আমাকে ক্ষমা করতে পারো, তবে আমিও তোমাকে মুক্তি দেব।” আবির অনুভব করল, মেয়েটির ছায়ামূর্তি আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সে যেন মুক্তি পেল। সেই রাতেই সে শান্তির ঘুমে ঢলে পড়ল। তার কষ্টের দিন শেষ হলো, মেয়েটি তাকে অভিশপ্ত সঙ্গ থেকে মুক্তি দিল। সেই ঘটনার পর থেকে আবির আর কখনো সেই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখেনি। |
0 মন্তব্যসমূহ