হাইওয়ের কুয়াশাচ্ছন্ন পথ

 

হাইওয়ের কুয়াশাচ্ছন্ন পথ

গভীর রাত। শহরের আলো অনেক পেছনে ফেলে, এক দীর্ঘ হাইওয়ের পথে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন রহিম। তিনি পেশায় পণ্যবাহী ট্রাক চালক, এবং এ রাতের চালানটা ছিল বিশেষ। শহর থেকে প্রায় দু'শো কিলোমিটার দূরে এক শহরতলিতে মাল পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি মাঝরাতেই রওনা দিয়েছেন। এই দীর্ঘ, নিস্তব্ধ হাইওয়ে তাকে চেনা হলেও, আজ যেন কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। রাস্তা কুয়াশায় ঢেকে ছিল, আর সেই কুয়াশার ভেতরে যেন ছায়া-ছায়া কিছু একটা লুকিয়ে আছে।


চালিয়ে যাচ্ছিলেন রহিম। রাস্তায় আশেপাশে কোনো গাড়ি নেই, কেবল দূরের কিছু গাছপালা আর কিছু পুরনো রাস্তার বাতি। বাতাসে এক ধরনের শীতলতা, যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা তাকে ঘিরে রেখেছে। ট্রাকের হেডলাইটের আলো কুয়াশার ভেতর দিয়ে গাড়িটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল এ পথের কোনো শেষ নেই।

কিছুক্ষণ পরেই তিনি খেয়াল করলেন, রাস্তার এক ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মহিলাকে। মহিলার গায়ে সাদা শাড়ি, আর মাথার চুলগুলো এলোমেলোভাবে ছড়ানো। তার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, কারণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। রহিম ভাবলেন, হয়তো কোনো যাত্রী পথ হারিয়ে ফেলেছেন। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, গভীর রাতে এমন জনহীন হাইওয়ের মাঝে এই মহিলা এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছেন?


কিছুটা কৌতূহল আর কিছুটা ভয়ের সাথে রহিম সামনের দিকে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মহিলাকে ছেড়ে কিছুটা দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু হঠাৎ করেই মনে হলো পিছনে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ির পেছনের আয়নায় দেখতে পেলেন, সেই সাদা শাড়ি পরা মহিলা এখনো তার গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন এবং তার দিকেই চেয়ে আছেন।

রহিমের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। ভয়ে ঠোঁট শুকিয়ে উঠল, কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে গাড়ি চালানো অব্যাহত রাখলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর ভাবলেন, হয়তো তার চোখের ভুল হচ্ছে, বা রাতের ঘোরে কল্পনা করছেন। কিন্তু ঠিক তখনই আবারো পেছনের আয়নায় চোখ গেল তার। দেখলেন সেই মহিলাটি এখনো তাকে অনুসরণ করছে, তবে এবার তিনি আরও কাছাকাছি চলে এসেছেন। তার মুখে এক ধরনের অভিশপ্ত শূন্যতা, আর চোখে ছিল অতিপ্রাকৃত এক দৃষ্টি যা রহিমকে গভীরভাবে ভীত করে তুলল।


রহিম এবার আরো দ্রুত গাড়ি চালানো শুরু করলেন, ভাবলেন এ থেকে মুক্তি পেতে পারেন। তবে যতই গাড়ি এগিয়ে নিচ্ছেন, ততই যেন সেই মহিলার উপস্থিতি বাড়তে লাগল। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে রহিমের দিকে টেনে নিয়ে আসছে। তার কণ্ঠ থেকে বেরোল ফিসফিস শব্দ, যা গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় ভয়াবহ রকমের সুতীব্র।


এক পর্যায়ে, তিনি দেখলেন রাস্তার ধারে কয়েকটি পুরনো গাছ, যা গভীর কুয়াশায় ঢেকে আছে। কুয়াশার ভেতর থেকে আবারও সেই মহিলার ছায়ামূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল। এ যেন এক অদ্ভুত বিভ্রম, যা বারবার তার পথ রোধ করছে। ট্রাকের হেডলাইট সরাসরি সেই মহিলার মুখে পড়তেই রহিম স্পষ্ট দেখতে পেলেন, তার মুখে কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই, চোখগুলো ছিল অন্ধকারে ঢাকা, আর তার ঠোঁটের কোণায় একটি শীতল হাসি।

রহিমের গা শিউরে উঠল। বুঝতে পারলেন তিনি এই রহস্যময় মহিলার খপ্পরে পড়েছেন, যাকে হয়তো পৃথিবীর আলো থেকে বহু আগে আলাদা করা হয়েছে, কিন্তু আজও এই কুয়াশাচ্ছন্ন পথে তার আত্মা ঘুরে বেড়ায়।


হাইওয়ের পরবর্তী বাঁকে গিয়ে রহিম একটি ছায়া দেখতে পেলেন। এটি সেই মহিলার মতোই, কিন্তু এবার তার সঙ্গে কয়েকটি অন্য ছায়াও যুক্ত ছিল, যারা ট্রাকের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তিনি খেয়াল করলেন, তাদের মুখেও সেই একই ভয়াবহ অভিব্যক্তি, যা তাকে ক্রমে গভীর ভয়ের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিচ্ছে।


রহিম জানতেন না কী করবেন। তার মনে হচ্ছিল যেন এই পথের আর শেষ নেই। কিছুক্ষণ পর একটি পুরনো সেতুর কাছে পৌঁছালে তিনি ট্রাক থামিয়ে দেখতে পেলেন, পুরো সেতুর ওপারে মহিলাটি দাঁড়িয়ে আছেন। তার চারপাশে যেন ছায়ার এক প্রাচীর গড়ে উঠেছে। রহিমের শরীর জমে গেল; তিনি অনুভব করলেন তার দেহের সমস্ত শক্তি তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

মহিলা ধীরে ধীরে ট্রাকের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তার প্রতিটি পদক্ষেপে যেন এক ধরনের অভিশপ্ত শক্তি রয়েছে যা এই শীতল কুয়াশাকে আরও গভীর করে তুলছে। রহিমের মনে হলো তিনি এখান থেকে আর ফিরে আসতে পারবেন না। তার সামনে এক অভিশপ্ত পথ, যার শেষ কোথায় তিনি জানেন না।


হঠাৎ করেই, রহিমের মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করল। তার চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে গেল, আর তিনি দেখতে পেলেন সেই মহিলার মুখ ভেসে উঠেছে তার সামনে। সেই অভিশপ্ত মুখ যেন তাকে সরাসরি মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি কোনো শব্দ করতে পারছিলেন না, কেবল অনুভব করছিলেন এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা স্পর্শ যা তার দেহে ছড়িয়ে পড়ছে।


পরের দিন সকালে, একটি স্থানীয় পুলিশ দল রাস্তার পাশে তার ফেলে রাখা ট্রাকটি খুঁজে পেল। কিন্তু রহিমকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। সেই ভয়ঙ্কর মহিলার গল্প প্রচলিত হয়ে যায় হাইওয়ের আশেপাশে, আর সেই রাতের ঘটনা লোকমুখে এক অভিশপ্ত গল্প হয়ে থাকে।

আজও হাইওয়ে ধরে রাতের গভীরে যারা সেই পথে যায়, অনেকেই বলে সেই কুয়াশাচ্ছন্ন পথে এক সাদা শাড়ি পরা মহিলার উপস্থিতি অনুভব করে, যে তাদের দিকে চেয়ে থাকে। আর তার চোখে থাকে মৃত্যুর মতো এক শীতল চাহনি, যা হাইওয়ের কুয়াশাচ্ছন্ন পথ ধরে এক অন্তিম যাত্রার ইঙ্গিত দেয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ