মিথ্যার কারাগার

 


সুজাতা একটি সাধারণ জীবন যাপন করছিল। তার শৈশব, কৈশোর, এবং বর্তমানের জীবন সবকিছুই ছিল এক রুটিনে আবদ্ধ। সে ঢাকায় একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে বাস করত এবং একটি প্রাইভেট অফিসে চাকরি করত। তবে সম্প্রতি, তার মনে এক অদ্ভুত শঙ্কা তৈরি হচ্ছিল। মাঝে মাঝে তার মনে হচ্ছিল, তার অতীতের কিছু ঘটনা হয়তো পুরোপুরি সঠিক নয়।


এমন একটি রাতে, যখন সে তার বিছানায় শুয়ে ছিল, হঠাৎ করে একটি মিষ্টি স্মৃতি মনে পড়ল। একটি পুরনো ছবি। ছবিটিতে সে একটি পুরানো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, চারপাশে কিছু পরিচিত মুখ ছিল। কিন্তু সেই পরিচিত মুখগুলোকে চিনতে পারছিল না। সে অনুভব করছিল, ছবিটির মধ্যে তার জীবনের একটি বড় সত্য লুকিয়ে আছে।


সুজাতা সিদ্ধান্ত নিল, সে এই ছবির রহস্য উন্মোচন করবে। সে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ শুরু করল, পুরনো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল, কিন্তু তারা কেউ তার স্মৃতি মনে করতে পারল না। এমনকি তার পরিবারও কোনো সাহায্য করতে পারল না।

একদিন, সে তার এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারল, তার পুরনো বাড়িটি একটি খালি বাড়ি হিসেবে পরিচিত। সেখানে গিয়ে সে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে চাইল। বাড়িটি একেবারেই ভগ্নদশায় ছিল, কিন্তু তার মধ্যে কিছু রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে, এমন অনুভূতি ছিল।


বাড়িতে প্রবেশ করার পর, সুজাতার মনে হল যেন কিছু অদ্ভুত অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরেছে। একটি কক্ষে, সে একটি পুরানো এলবাম খুঁজে পেল। এলবামটি খুলে, সে বিভিন্ন ছবির মধ্যে তার নিজের একটি ছবি দেখল। কিন্তু ছবি দেখে তার মনে পড়ে গেল না, সে কখনো সেখানে ছিল কি না।


সুজাতার মনে আতঙ্ক জমা হতে লাগল। সে বাড়ির গভীরে প্রবেশ করতে লাগল এবং একটি পুরানো ডায়েরি খুঁজে পেল। ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলোতে লেখা ছিল তার অতীতের কিছু ঘটনা, কিছু এমন যা সে আগে কখনো শুনে নি।


“মিথ্যা কখনো চাপা থাকে না,” একটিতে লেখা ছিল। “আমি জানি তুমি খুঁজছ। তোমার সত্য তোমার কাছেই লুকিয়ে আছে।”


সুজাতা হতবাক হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল, কিছু গোপনীয়তা তার থেকে লুকানো হয়েছে। তার পূর্বের জীবন সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। সে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল।


বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে, সুজাতার মাথায় অনেক প্রশ্ন ছিল। সে পুরনো এলাকার পুরনো বাসিন্দাদের কাছে গিয়ে জানতে চাইল, কিন্তু তারা কোনো তথ্য দিতে পারল না। হতাশ হয়ে, সে আরও একটি পর্যায়ে পৌঁছাতে চেষ্টা করল।

একদিন, সে একটি স্থানীয় লাইব্রেরিতে গেল এবং সেখানে একটি পুরানো সংবাদপত্রে একটি খণ্ড খুঁজে পেল। সেখানে লেখা ছিল, “একটি পরিবার রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছে।”


সুজাতা তার নামের কথা ভাবতে লাগল। “কীভাবে সম্ভব? আমি তো এখানে বড় হয়েছি। কেন আমার স্মৃতি অস্পষ্ট?”


এখন সে সঠিকভাবে বুঝতে পারছিল, তার জীবন একটি মিথ্যার কারাগারে বন্দি। সে জানতে চাইছিল, তার পরিচয় কোথায়। সে আবিষ্কার করল, তার মা মারা যাওয়ার পর তাকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কে? কেন?


এক রাতে, সে একটি ছায়ার উপস্থিতি অনুভব করল। “সুজাতা, তুমি সত্য জানার জন্য প্রস্তুত?” এক রহস্যময় কণ্ঠ তার কানে বাজল।


“কে তুমি? তুমি কে?” সুজাতার কণ্ঠ।


“আমি তোমার অতীত। আমি তোমার মা।”


সুজাতা তার চোখের সামনের অন্ধকারে একটি নারীর ছায়া দেখতে পেল। “না! এটা অসম্ভব!”


“সম্ভব। তুমি জানতে পারবে, তুমি কে, এবং কেন তোমার জীবন এতটা বদলে গেছে,” মা বলল।


সুজাতার মনে নতুন প্রশ্ন উঠল। “কীভাবে তুমি আমার কাছে আসলে?”


কারণ আমি এখানে আছি, তোমার কাছে আসার জন্য। তোমার জীবন একটি খেলনা, এবং এটি একটি পুতুলের মতো। এখন সময় এসেছে সব সত্যি বলার।”


সুজাতার মনে বিশাল শঙ্কা তৈরি হল। “তুমি কেন আমাকে মিথ্যা বলেছিলে?”


“কারণ তুমি জানলে, তুমি সত্যি জানতে পারলে, তুমি বিপদের মধ্যে পড়তে। তোমার পরিচয় খুব বিপজ্জনক। তুমি আসলে একটি গোপন সংস্থার সন্তান। তোমার পিতা একজন গুপ্তচর।”


এখন সুজাতার মনে হতাশার পাশাপাশি ক্রোধও জেগে উঠল। “কেন আমাকে বললে না? কেন আমাকে একা ছেড়ে দিলে?”

“কারণ আমি চাইনি তুমি বিপদের সম্মুখীন হও। কিন্তু এখন তুমি বড় হয়ে গেছ, তোমার সত্য জানতে হবে।”


সুজাতার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি জেগে উঠল। সে তার অতীতকে জানার জন্য এক নতুন উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। সে জানতে চাইছিল, তার পিতা কোথায়? কেন সে অদৃশ্য?


এখন সুজাতার খোঁজ শুরু হল। তিনি বিভিন্ন সংস্থার অফিসে যোগাযোগ করতে লাগলেন, যেখানে গোপনীয়তার কাজ হয়।


এবার সে অনলাইনে তদন্ত শুরু করল। একটি সন্দেহজনক নামের সন্ধানে সে পৌঁছাল, যেটি তার বাবার সাথে যুক্ত ছিল। তার নাম ছিল রাহুল। সুজাতার মনের মধ্যে ছিল অনেক প্রশ্ন। “তিনি কি এখনো বেঁচে আছেন?”


একদিন, সে একটি ইন্টারভিউয়ের জন্য একটি সংবাদমাধ্যমে গেল। সেখানে সে তার বাবার সম্পর্কে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল। “আমি একটি গুপ্তচরের সন্তান, এবং আমার বাবা সম্পর্কে আমি জানতে চাই।”


সাংবাদিকরা প্রথমে অবাক হয়েছিল, কিন্তু পরে তারা তার গল্প শুনে আগ্রহী হলেন। সুজাতার কথা শুনে তারা একটি অনুসন্ধান শুরু করলেন।


কিছু সময় পর, সুজাতার পিতা সম্পর্কে কিছু তথ্য বেরিয়ে এল। তিনি একটি গুপ্ত সংস্থার সদস্য ছিলেন এবং কয়েক বছর আগে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন।

সুজাতা এখন অনুভব করছিল, সে কি করতে চায়। তার বাবার জন্য সাহায্য করতে হবে। সে স্থির করল, সে তার বাবার সাথে যোগাযোগ করবে।


সে তার বাবার পুরনো সহকর্মীদের কাছে পৌঁছাল। তারা তাকে বলল, “তোমার বাবা বেঁচে আছেন, কিন্তু কোথায় আছে তা জানি না।”


সুজাতা হতাশ হয়ে গেল। তবে সে হাল ছাড়ল না। সে বিভিন্ন স্থান ঘুরে, তার বাবার সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে গেল।


এক রাতে, সে একটি ভিন্ন শহরে পৌঁছাল। সেখানে একটি পুরনো বাড়িতে সে একটি চিঠি পেল। চিঠিটি তার বাবার লেখা ছিল।


“প্রিয় সুজাতা, আমি জানি তুমি আমাকে খুঁজছ। আমি তোমার কাছে আসব। কিন্তু সাবধান হও, অনেক বিপদ তোমার চারপাশে। তোমার পরিচয় জানলে তোমার জীবনের ওপর হুমকি আসবে। আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারব না।”


সুজাতার চোখে জল এসে গেল। “না! আমি তোমাকে খুঁজে বের করতে চাই। আমি কিছু জানতে চাই।”


পরের দিন, সুজাতার পরিচয় একদম বদলে গেল। সে আর সুজাতা নয়, সে তার বাবার সত্যিকারের পরিচয় খুঁজতে বেরিয়েছে।


একদিন, সে একটি পুরনো সংস্থার অফিসে পৌঁছাল, যেখানে তার বাবার কাজের তথ্য ছিল। সেখানে গিয়ে সে জানতে পারল, তার বাবা একজন প্রতিভাধর গুপ্তচর ছিলেন। কিন্তু কেন তাকে এতদিন ধরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল?

এখন, সুজাতা সম্পূর্ণরূপে বদলে গিয়েছিল। সে তার বাবার খোঁজে একটি অভিযানে বেরিয়ে পড়ল। সেই অভিযানে সে জানতে পারল, তার বাবার একটি বিরাট গোপন পরিকল্পনা ছিল।


অবশেষে, সুজাতা তার বাবাকে খুঁজে পেল। “বাবা, তুমি কোথায় ছিলে?”


“মেয়ে, আমি তোমার জীবনকে রক্ষা করার জন্য সরে গিয়েছিলাম। তুমি জানলে, তুমি বিপদের মধ্যে পড়তে। আমি এখন তোমার কাছে আছি।”


সুজাতা জানতে পারল, তার বাবা তার জীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তবে সেই অধ্যায়টি ছিল বিপজ্জনক।

এখন সুজাতা একটি নতুন জীবন শুরু করতে চাইল। সে তার বাবার সাথে একসাথে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিল। তাদের সম্পর্ক নতুন করে তৈরি হল, এবং তারা একসাথে মিথ্যার কারাগার থেকে বেরিয়ে আসল।


সুজাতা উপলব্ধি করল, তার অতীতের অন্ধকার সত্যগুলোকে তিনি সম্মুখীন করতে প্রস্তুত। তার জীবন ছিল একটি যাত্রা, যা তাকে একজন শক্তিশালী ও সাহসী মহিলায় পরিণত করেছিল।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ